বিডি প্রতিবেদক :
কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক উপকূলে ট্রলার থেকে ১০ মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার আটক ১ নাম্বার আসামি কামাল হোসেন প্রকাশ বাইট্টা কামাল আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তিনি পুরো একটি ঘটনার বর্ণনা দেন,বলেছেন, জেলে আক্কাস থেকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তিনি জানতে পেরেছেন, তার ভাই আনোয়ারের বোটে থাকা ডাকাতদের (তার মতে) আটকিয়ে বাঁশখালী কুতুবদিয়ার দুটি বোটের লোকজন সহ বাঁশ, বরফ মুন্ডা ( বরফ বাঙ্গার গাছের লাঠি ) লাকড়ি দিয়ে গণপিটুনিতে তারা মারা গেলে তাদের বোটেই মাছ রাখার হিমাগারে প্রবেশ করিয়ে মুখ বন্ধ করে দিয়ে অন্য একটি বোট দিয়ে গুতা মেরে সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। জাবানবন্দিতে তিনি কয়েকজনের নাম ও উল্লেখ করেছেন। (১ মে) সন্ধ্যায় কক্সবাজার সদরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আখতার জাবেদ তার এই জবানবন্দী রেকর্ড করেন।
পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে মামলার এজাহারভূক্ত ১ নম্বর আসামি মাতারবাড়ী সাইরার ডেইলএলাকার মোঃ ইলিয়াসের পুত্র ট্রলারমালিক বাইট্টা কামাল ও ৪ নম্বর আসামি ট্রলারের মাঝি করিম সিকদারকে সোমবার (১ মে) আদালতে তোলা হয়।
কক্সবাজার সদরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আখতার জাবেদের আদালতে তোলা হলে করিম সিকদার জবানবন্দি দিতে রাজি হননি। তবে বাইট্টা কামাল ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কামালের জবানবন্দি নেন বিচারক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে কামাল হোসেন ওরফে বাইট্টা কামাল বলেছেন, তিনি ফিশিং বোটের ব্যবসা করেন। আগে ১০-১২টা বোট থাকলেও লোকসানের কারণে সবগুলো বিক্রি করে দিয়ে এখন মাত্র একটি বোট রয়েছে ( মাছ ধরার ট্রলার)। তিনি পুরো রমজান মাস জুড়ে কক্সবাজার শহরের বিমানবন্দর মসজিদে তারাবি আদায় করেছেন। ৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় চা খাওয়ার সময় তার স্ত্রী ফোন দিয়ে জানায়, তার ভাই আনোয়ারের বোটে সকালে ডাকাতি হয়েছে। তার স্ত্রী আরো জানায়, বিষয়টি তাকে নবী হোসেন বলেছে। তখন কামাল তার পিতা ইলিয়াসকে ফোন করে, তার পিতা শুনেছে আব্দুল গফুর থেকে, তখন তিনি তার আব্বার ফোন থেকে গফুরের সাথে কথা বলে, গফুর তার ছোটভাই জেলে বেলালের কাছ থেকে শুনেছে, এরপর তাকে বেলালের ফোন নম্বর দেয। অনেক চেষ্টা করেও বেলালের ফোনে সংযোগ না পাওয়াই ঐদিন তারাবির নামাজ শেষে বাসায় গিয়ে বেলালের নাম্বারে আবার ফোন দেন, ফোনটা রিসিভ করে আক্কাস ( জেলে এবং বেলালের ছোট ভাই) , তখন আক্কাসের সাথে তার কথা হয়। মোবাইল ফোনে কামালকে আক্কাস জানায়, আনোয়ারের বোট ডাকাতি হয়েছে। কয়েকজন লোক আহত হয়েছে, ভোটের ইঞ্জিনের শব্দের কারণে ভালো করে বুঝা যাচ্ছে না, বাকি কথা সকালে হবে বলে ফোন রেখে দিয়ে পরদিন সকালে আবার আক্কাস কে ফোন দেন কামাল।
জেলে আক্কাস তখন কামালকে জানান, আনোয়ারের বোট রাতে জালের সাথে রশি বাধা ছিল। হঠাৎ করে আনোয়ারের বোটের পাশে একটা বোট আসে, তখন আনোয়ারের বোটের জেলে ফুরকান বোট থেকে সার্চলাইট দিয়ে একটা আলো দেয়, আলোতে একটি ছোট বোট বলে মনে হয়।
কিছুক্ষণ পরেই ওই ছোট বোটটি আনোয়ারের বোটের ডান দিকে বিরাই ( পাশে ভিডিয়ে) দেয়, সাথে সাথেই ওই বোটের লোকজন গালাগালি করে দা,কিরিছ, লোহার রড ও বন্ধুক নিয়ে আনোয়ারের বোটে উঠে পড়ে এবং আনোয়ারের বোটের সব জেলেকে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে। এক পর্যায়ে কায়সার ও জয়নাল মাঝি ছাড়া বাকি সব জেলেকে হিমগারে ঢুকিয়ে ফেলে। তারপর তারা কায়সারকে বোট স্টার্ট দিতে বাধ্য করে। আনোয়ার ভোটের সাথে তাদের বোট বাধা থাকে। এরপর জালের সাথে বেঁধে থাকা বন্ধন কেটে দিয়ে বোটটি পূর্ব উত্তরে চলছিল তাদের নির্দেশনায়। এসময় তারা জয়নাল ছাড়া বাকি সব জেলেদের সাগরে ফেলে দেয়। তারপর তারা আরেকটি বোটের সাথে ভিড়াইতে বলে, বোট বেড়াইতে একটু দেরি হওয়ায় ওই বোট টি চলে যায়। এতে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে গালাগালি করে জয়নাল ও কায়সার কে সাগরে ফেলে দেয়। এরপর তারা আনোয়ারের ভোট নিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে আসতেছিল।
জবানবন্দিতে কামাল হোসেন ওরফে বাইট্টা কামাল বলেন, আফসার মাঝি ও বাবুল মাঝির বোট গুলো আনোয়ারের বোট চিনতে পারে, ফলে বোট খালি হওয়াতে তাদের সন্দেহ হয়, সন্দেহ থেকে আফসার মাঝি ও বাবুল মাঝির বোট আনোয়ারের বোটের পাশেই ভিড়তে চাইলে, তারা নিষেধ করে, সন্দেহ আরো ঘনীভূত হলে আবসার মাঝি ও বাবুল মাঝি জয়নাল, কায়সার ও আনোয়ার কে নাম ধরে ডাকতে থাকে। কিন্তু তাদের সাড়াশব্দ না পাওয়াই বাবুল মাঝির বোট তাদের বোটের পাশে ভিড়তে চাইলে তারা বাবুল মাঝির বোটে গুলি করে। ফলে বাবুল মাঝি ও আফসার মাঝি, লুঙ্গি দ্বারা এবং ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়া দ্বারা অন্যান্য বোটকে বিপদ সংকেত দেখালে ২০ /৩০ মিনিটের মধ্যে ওই বোটের আশেপাশে ১০-১২টি বোট চলে আসে। তখন তারা এলোপাতাড়ি গুলি করতেছিল। এক পর্যায়ে তাদের মূল বোটি আনোয়ারের বোট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন আনোয়ারের বোটকে অন্যান্য সকল বোটগুলো ধাওয়া করতেছিল।
জবানবন্দিতে কামাল আরো বলেছেন, এক পর্যায়ে তাদের গুলি ফুরিয়ে গেলে বাঁশখালী ও কুতুবদিয়ার দুটি বোট দুইপাশ থেকে এসে আনোয়ারের বোটকে মাছ বরাবর চাপ দিয়ে তামিয়ে উক্ত বোটে থাকা লোকজনকে (তার মত ডাকাতদের ) আটকে ফেলে । বাঁশখালী কুতুবদিয়ার দুটি বোটের লোকজন সহ বাবুল মাঝি, আফসার মাঝি, আমানুল্লাহ, আনোয়ারের ভোটের জেলেরা ( তার মতে ডাকাতদের) তাদের ঘিরে ধরে বাঁশ, বরফ মুন্ডা (বরফ ভাঙ্গানোর গাছের লাঠি) ছুলা জ্বালানোর লাকড়ি দিয়ে গণপিটুনি দিতে থাকে। গণপিটুনিতে (তার মতে ডাকাত) এক পর্যায়ে মারা গেলে, আফসার মাঝি, বাবুল মাঝি, আমানুল্লাহ মাঝি, আনোয়ার মাঝি ও অন্যান্য বোটের জেলেরা তাদের বোট খুজে নিয়ে, উক্ত বোটের মাছ রাখার হিমাগারে তাদের লাশগুলো প্রবেশ করিয়ে হিমগারের মুখ বন্ধ করে দিয়ে বোট টি অন্য একটি বোট দিয়ে গুতা মেরে সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয় বলে কামাল তার জবানবন্দিতে বলেছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
গত ২৩ এপ্রিল বিকেলে কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক উপকূলে ডুবন্ত একটি মাছ ধরার ট্রলার থেকে ১০ জনের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস। ২৫ এপ্রিল কক্সবাজার সদর মডেল থানায় এজাহারনামীয় ৪ জন মহেশখালীর মাতারবাড়ীর বাইট্যা কামাল, করিম সিকদার, আনোয়ার হোসেন ও বাবুল মাঝি এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করে মামলা করেন ডুবন্ত ট্রলারের মালিক ও মহেশখালীর হোয়ানক ইউনিয়নের বাসিন্দা নিহত সামশুল আলমের স্ত্রী রোকিয়া আকতার।
মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিদের ৪টি ট্রলারের ৫০ থেকে ৬০ জন লোক মিলে সামশুলের ট্রলারটি জিম্মি করে পরবর্তী সময়ে সামশুলসহ অন্যদের গলায় রশি পেঁচিয়ে, হাত–পা রশি ও জাল দিয়ে বেঁধে মারধর করে মাছ রাখার হিমাগারে ভেতর আটকে রাখেন এবং ওপর থেকে ঢাকনায় পেরেক মেরে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে ট্রলারের তলা ফুটো করে দেন। এতে সেটি ডুবে যায়। সামশুলের সঙ্গে এজাহারনামীয় চার আসামির পূর্বশত্রুতা ছিল।
মামলা করার দিনই মাতারবাড়ী থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বাইট্যা কামাল ও করিম সিকদারকে। বাইট্যা কামাল মামলার ১ নম্বর এবং করিম সিকদার ৪ নম্বর আসামি। বাইট্যা কামাল ও করিম সিকদার পুলিশের কাছে পাঁচ দিনের রিমান্ডে ছিল। রিমান্ড শেষে কামাল হোসেন উরফে বাইট্টা কামাল আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিলেও করিম সিকদার জবানবন্দি দিতে রাজি হননি।
মামলার গ্রেপ্তার অপর আসামি গিয়াস উদ্দিন মুনিরকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। মঙ্গলবার রাতে তাঁকে বদরখালী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে এ পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে তিন আসামি কামাল হোসেন উরফে বাইট্টা কামাল,ফজল ও তৈয়ূব কে রিমান্ড শেষ হলে আদালতে হাজির করা হয়। তারা তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা কী বলেছেন, তিনি জানেন না। অন্য দুই আসামি জবানবন্দী দেননি।
ওসি আরও বলেন, এ মামলার এজাহারনামীয় অপর দুই আসামি আনোয়ার কামাল ও বাবুল মাঝির বাড়ি মহেশখালীতে। ঘটনার পর থেকে দুজন আত্মগোপনে রয়েছেন।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, এ ঘটনার সাথে জড়িতদের গ্রেফতারে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।