এম আর মাহমুদ :
নির্বাচনে জয় পরাজয় থাকবে, কেউ বিজয়ী উল্লাস করবে, কেউ পরাজিত হয়ে ভক্ত অনুরুক্তদের নিয়ে মাতম করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে নির্বাচন সব সময় আনন্দময় হয়ে থাকে। আবার কোন কোন নির্বাচন বেদনা বিঁধুরও হয়। জাতীয়, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদ এমনকি সমিতির নির্বাচনেও হৃদয় বিদারক ঘটনা আমরা দেখেছি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংস ঘটনায় অনেকে প্রাণ দিতেও দেখেছি। তারপরও নির্বাচন যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। কারণ গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচন ছাড়া প্রতিনিধি নির্বাচনের বিকল্প কোন পদ্ধতি এখনও বের হয়নি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিলেকশন পদ্ধতিও বিদ্যমান রয়েছে। যেমন ৩ পার্বত্য জেলার জেলা পরিষদ নির্বাচন এরশাদ জামানায় অনুষ্ঠিত হওয়ার পর আজ পর্যন্ত আর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। সরকার কর্তৃক মনোনীত প্রতিনিধিরা মাজারের গদিনশীন খাদেমের মত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। সদ্য সমাপ্ত কক্সবাজার জেলা পরিষদ নির্বাচন দেখার সৌভাগ্য আল্লাহ দিয়েছে। তার জন্য হাজার শুকরিয়া। ১৯৭৭ সাল থেকে ভোটার না হলেও ভোটের আনন্দময় বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখেছি। সে সময়ের নির্বাচন আর বর্তমান সময়ের নির্বাচনের মধ্যে অনেক পার্থক্য। জেলা পরিষদ নির্বাচন গণতান্ত্রিক ধারায় সম্পন্ন হয়েছে বলে আমজনতা মনে করে না। এখানে দেশের সব জনগণের ভোটাধিকার নেই। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের প্রবর্তিত মৌলিক গণতন্ত্রের আদলেই জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ পদ্ধতিতে ২ বার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম জেলা পরিষদ নির্বাচনে খান বাহাদুর মোস্তাক আহমদ চৌধুরী আওয়ামীলীগের দলীয় প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছিলেন। তবে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন কক্সবাজার জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও চকরিয়া পেকুয়া আসনের সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা সালাহ উদ্দিন মাহমুদ। তিনি বৈরী পরিস্থিতিতেও ২১৯ ভোট পেয়েছিলেন। পরাজিত হয়েও তিনি মোস্তাক আহমদ চৌধুরীকে অভিনন্দন জানাতে কৃপণতা করেনি। এটাই নির্বাচনের জয় পরাজয়ের শিষ্টাচার। গণতন্ত্রের সুফল যেমন আছে, তেমনি কুফলও রয়েছে। বিশেষ করে অনেক ক্ষেত্রে ভোটারেরা অর্থ লোভে অযোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। এক সময় ভোটারেরা প্রার্থীর যোগ্যতা, সামাজিক মর্যাদা, এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা দেখে ভোট দিতেন। তবে এখন সেই চিত্র আর নেই। সদ্য সমাপ্ত জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান সংরক্ষিত মহিলা সদস্য ও সাধারণ সদস্য নির্বাচিত হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের ভোটে। এ নির্বাচনের ভোটার সংখ্যা ছিল ৯৯৯। তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন কক্সবাজার জেলার রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান আ’লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী শাহিনুল হক মার্শাল, কুপোকাত হলেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের প্রবীণ ব্যক্তিত্ব ও আওয়ামীলীগের মনোনীত প্রার্থী কে.বি মোস্তাক আহমদ চৌধুরী। অনেকে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে অসন্তুষ্ট। তবে করার কিছুই নেই। কারণ আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে কোন্দল রয়েছে। যার বিস্ফোরণ ঘটেছে জেলা পরিষদ নির্বাচনে। সাথে ছিল টাকার খেলা। ভোটারেরা ইচ্ছামত ভোট বেচা-কেনা করেছে। এতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত তৃণমূলের প্রতিনিধিদের চরিত্র নিয়ে এখন সাধারণ ভোটারেরা নানা প্রশ্ন তুলছে। হয়তো ভবিষ্যৎ নির্র্বাচনে জনগণ ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে ভোট বেচার দায়ে অভিযুক্ত মেম্বারদের কাছ থেকে কড়ায় গন্ডায় হিসাব নেবে। বেরসিক একজন সাবেক জনপ্রতিনিধি মন্তব্য করতে শোনা গেছে, এমন নির্বাচন জীবনে আর দেখিনি। একজন ভোটার সব প্রার্থীর কাছ থেকে কম বেশি টাকা নিয়েছে। তবে শেষ মূহুর্তে টাকার পরিমাণ যিনি বেশি দিয়েছেন, তাকেই ভোট দিতে দেখা গেছে। কেউ মাজারে, কেউ মসজিদে, কেউ উপাসনালয়ে গিয়ে টাকা নিয়েছে বলেও শোনা যাচ্ছে। এ কারণে তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিদের চরিত্র সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে রেখাপাত করেছে। একজন বিজয়ী প্রার্থীর সমার্থক দাবী করেছেন তারা বিজয়ের জন্য ২২০ জনের ভোট ক্রয় করেছে সর্বোচ্চ দামে। কিন্তু পেয়েছে অর্ধেক। বাকীরা কি টাকা নিয়ে ভোট দিল না? এমন প্রশ্ন মনে আসার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
এদিকে জেলা পরিষদের একজন সম্মানিত চেয়ারম্যান প্রার্থী জগদীশ বড়–য়া তিনি কবি ও আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভে এসে একটু অশালীন ভাষায় কিছু কথা বললেও একেবারে অমূলক বলেনি। তিনি নাকি সবকজন ভোটারের সাথে মোবাইলে কথা বলেছেন। প্রায় ৬ শতাধিক ভোটার তার কাছ থেকে ইশারা ইঙ্গিতে টাকা চেয়েছে। আবার কেউ কেউ টাকার আশ্বাস না পেয়ে অশালীন আচরণ করতেও ভুল করেনি। তার ভাষায় পুরো জেলায় ৪ শতাধিক ঈমানদার ভোটার আছে। যারা তার সাথে বিনয়ের সাথে কথা বলেছেন, টাকা দাবী করেননি। তিনি সেই ভোটের আশাবাদী ছিলেন। তবে পেয়েছেন ৯টি। বিনা পয়সায় ৯টি ভোট পেয়েছেন, যা বর্তমান সময়ের জন্য বিরল। তার বক্তব্যে কিছু অশালীন ও অসঙ্গতিপূর্ণ কথা বললেও বাস্তবতার নিরীখে অকপটে সত্যই বলেছেন। নগ্ন ভাষায় ফিতা খোলা প্রসঙ্গে একটি কথা বলেছেন। যা কারও পক্ষে লিখে প্রকাশ করা রুচিতে বাঁধে। আসলে কথাটিই যথার্থ। ইতিমধ্যে আধ্যাত্মিক নেতা জগদীশ বড়–য়া কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লোনা পানিতে স্নান করে পুত-পবিত্র হয়ে ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবেন। সব শেষে জনগণ তৃণমূলের প্রতিনিধিদের চরিত্র নষ্ট হয় এমন ভোট আর চায় না। ইচ্ছা করলে সরকার মনোনীত প্রতিনিধি দিয়ে জেলা পরিষদ পরিচালনা করতে পারে। তাতে কোন সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। বর্তমানে ৩টি পার্বত্য জেলা পরিষদ কি মনোনীত প্রতিনিধি দিয়ে চলছে না? তাহলে অবশিষ্ট ৬১টি জেলা পরিষদে নির্বাচনের কি প্রয়োজন ছিল? সবকথার শেষ কথা এমন কালো টাকা বিতরণের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়া জেলা পরিষদ নির্বাচনে যারা বিজয়ী হয়েছে। তাদের কাছে প্রত্যাশা জেলার উন্নয়নে আপনারা ভূমিকা রাখবেন। পরাজিতদের কাছে অনুরোধ, আপনারা হতাশ হবেন না। আপনাদের প্রতি সমবেদনা। কবির ভাষায় ‘একবার পারিলে দেখ শতবার, না পারিব না পারিব একথাটি বলিব না আর।’ তবে ভোট দেয়ার অঙ্গীকার করে যেসব প্রতারক ভোটার একাধিক প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছে, তাদের কাছ থেকে টাকাগুলো উদ্ধার করে নেয়ার দরকার বলে আমজনতার অভিমত। এতে ভবিষ্যতে আর কোন ভোটার এমন প্রতারণা করবে না।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক,কলাম লেখক