মুকুল কান্তি দাশ :
সাভার, যশোর, কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন জেলায় ফুল চাষ হলেও গত এক দশক ধরে দক্ষিণ চট্টগ্রামের চকরিয়ায় উৎপাদিত ফুল বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও রাজধানীর চাহিদা পূরণেও অংশীদার হয়ে উঠেছে। তাই আসন্ন ভালবাসা দিবস এবং মাতৃভাষা দিবসকে ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করছে চকরিয়ার ফুল চাষিরা।
জানা যায়, কক্সবাজারের চকরিয়া বরইতলী ইউনিয়নের মাঝ দিয়ে যাওয়া কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দু’পাশ জুড়েই বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ করা হয়।
ফুল ছাড়া প্রিয় মানুষকে মনের কথা জানানো যায়না। তাইতো ভালবাসা দিবসে কয়েকগুন বেড়ে যায় ফুলের চাহিদা। সে সঙ্গে বেড়ে যায় ফুল চাষি ও ফুলকন্যাদের ব্যস্ততাও। কাপড় ও প্লাস্টিকের তৈরী কৃত্রিম ফুলের কারণে আসল ফুলের বাজারের চাহিদা হ্রাস পেলেও কমেনি কদর।
প্রতিবারের মত এবারও সে কদর আকাশচুম্বি হয়ে উঠেছে পরপর দুটি দিবসকে ঘিরে। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালবাসা দিবস ও ২১ ফেব্রুয়ারি আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস রয়েছে। এই দুটি দিবসে ফুল সরবরাহ করে অধিক মুনাফা অর্জন লক্ষে বেশ কদিন ধরে ঘাম ঝরানো খাটুনি কাটছে এই অঞ্চলের ফুল চাষিরা।
এক সপ্তাহের মধ্যে দুটি দিবসে অন্তত অর্ধ কোটি টাকার ফুল বিক্রয়ের টার্গেট নিয়ে চকরিয়ার ফুল চাষিরা পরিশ্রম করে যাচ্ছে। ১১ ফেব্রুয়ারি থেকেই চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফুল সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়েছে তারা।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এক পাশে সবুজ ধান ও সবজির মাঠ, অন্য পাশে গাছ-গাছালিতে ভরপুর বনের পাহাড়। গ্রাম বাংলার এ রুপকে আরও বেশি সৌরভিত করে তুলেছে গোলাপ ও গ্লাডিওলাস বাগান।
মহাসড়ক লাগোয়া বরইতলী ইউনিয়নের সড়কের দু’পাশে একের পর এক ফুলের বাগান। পর্যটন জেলা কক্সবাজারমুখি পর্যটকদেরও নজরকাড়ে এ সৌরভিত ফুল। বরইতলী ও সাহারবিল উপজেলায় শতাধিক ব্যক্তির ফুলের বাগান রয়েছে। অন্তত ১’শ একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে করা হয়েছে ফুলের চাষ।
মাঠে গেলে দেখা মিলে বেশ ক’জন নারী-পুরুষের। তাদের কেউ বাগান পরিচর্যা করছিলো। কেউ তুলছিল ফুল। আবার কেউ বান্ডিল করে খামার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিল। সেখান থেকে রিক্সা ও ভ্যান গাড়িতে করে স্টেশনে নিয়ে পিকআপ বোঝাই করে বিক্রয়ের জন্য চট্টগ্রামসহ নানাস্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।
চাষিদের ভাষ্য মতে, সুর্যের তাপ বাড়ার আগেই গ্লাডিওলাস তুলে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার আড়তে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ভোর থেকে সারাদিনেই তোলা হয় গোলাপ ফুল।
স্থানীয় ফুল চাষি এনামুল হক বলেন, প্রায় দুই একর জমিতে গোলাপ ও এক একর জমিতে গ্লাডিওলাস এবং চাষি আজাদ হোসেন তিন একর জমিতে গোলাপ ও ১ একর ৪০ শতক জমিতে গ্লাডিওলাস চাষ করেছেন। দুজনের ফুল বাগানেই ১০-১৫জন করে শ্রমিক রয়েছে। শ্রমিকদের সিংহভাগই নারী। কম মজুরিতে নিরলস পরিশ্রম করতে পারাইয় ফুল বাগানের কাজে নারী শ্রমিকদের চাহিদাও বেশি।
দুই ফুল চাষি বলেন, প্রতি কানি জমি ২০-২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে বর্গা নিয়ে তারা ফুল চাষ করেছেন। তন্মধ্যে কলম দেয়া গোলাপ একবার রোপন করলে ৪-৫ বছর ফুল পাওয়া যায়। গ্লাডিওলাস চাষ করে তিন মাস মেয়াদের মধ্যেই ফুল বিক্রয় শেষ করতে হয়। তাদের মতে ৪০ শতক জমিতে ফুল চাষ করতে ১ লাখ টাকা খরচ হয়। চাহিদা ও ন্যায্য মূল্য পাওয়া গেলে ভাল মুনাফা হয়।
তবে, বাজারে কাপড় ও প্লাস্টিকের চায়না ফুল আসায় তাদের কষ্টে উৎপাদিত ফুলের বাজারে আঘাত করেছে। তারা বলেন, যশোর থেকে আমরা প্রথমে গ্লাডিওলাস বীজ সংগ্রহ করেছিলাম। পরে নিজেদের চাষ থেকেই বীজ সংগ্রহ করি পরবর্তী মৌসুমের জন্য। অনুরুপভাবে নিজেদের করা বাগানের গোলাপ গাছ থেকে কলম করে চারা সংগ্রহপূর্বক ফুল চাষ করে থাকি।
আজাদ হোসেন ও এনামুল হক আরও বলেন, একটি গ্লাডিওলাস উৎপাদনে খরচ হয় ৪-৫ টাকা আর বিক্রয় হয় ১২-১৩ টাকা। গোলাপ উৎপাদনে চল্লিশ থেকে পঞ্চশ পয়সা ফুল প্রতি খরচ হয়। বিক্রয় হয় ৬ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত। তবে, বাজার চাহিদা হ্রাস পেলে খরচের টাকাও উঠে না ফুল বিক্রয় করে।
বরইতলী ফুল বাগান মালিক সমিতির সাবেক আহবায়ক মঈনুল ইসলাম বলেন, চকরিয়ায় শতাধিক ব্যক্তি অন্তত কয়েক’শ একর জমিতে ফুল চাষ করেছে এবার। দুই বছর পূর্বে তিন থেকে সাড়ে তিনশ একর জমিতে ফুল চাষ হলেও কৃত্রিম ফুলের কারণে চাষের পরিমাণ কমে গেছে। তাছাড়াও গত বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় বেশির ভাগ বাগান নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। এবার আবারও নতুন করে চারা রোপণ করছে চাষিরা। তবে, এরার বিভিন্ন দিবসের পাশাপাশি সারা বছরই ভালো ফুল বেচাবিক্রি হয়েছে। চাহিদা বাড়ায় অধিক ফুল বিক্রয় হয়। এবার চাষিরা ভালোই মুনাফা পাবে বলে আশা করছি।
তিনি বলেন, শুধু মাত্র শতাধিক চাষি নয়, চকরিয়ার ফুল বাগানে শ্রমজীবির কাজ করে ৩ থেকে ৪ হাজার শ্রমিক পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে। অনেক শ্রমিক প্রথমে অন্যের জমিতে কাজ করলেও এখন নিজেরাও জমি বর্গা নিয়ে বাণিজ্যিক চাষ শুরু করেছে।
চকরিয়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এসএম নাসির হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, চকরিয়ার সরকারি হিসেবে ১২০ একর জমিতে গোলাপ ও ৮৭ একর জমিতে গ্লাডিওলাস চাষ হয়েছে। এক কানি জমিতে বছরে গোলাপ উৎপাদন হয় প্রায় ৪৭ হাজার এবং গ্লাডিওলাস উৎপাদন হয় প্রায় ১০ হাজার করে।
তিনি বলেন, সরকারিভাবে ফুল চাষিদের সাহায্য করার কোন সুযোগ নেই।