:: ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান ::
দেশ-বিদেশের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর পথ হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ উল্টোপথে চলতে থাকে। বাংলার স্বাধীনতার চেতনার সূর্যটা অস্তমিত হয়ে যায়। দেশ অন্ধকারের পতিত হয়। শুরু হয় ইতিহাস বিকৃতি। যে পাকিস্তানি ভাবধারা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বাংলাদেশের লাখো মানুষের জীবনদান, পাকিস্তানি ওই সাম্প্রদায়িক ভাবধারা দেশে পুনরায় জাগ্রত হয়। ধর্মান্ধ-মৌলবাদী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হয় পুরো দেশ। শোষক শ্রেণির হাতে চলে যায় দেশের নিয়ন্ত্রণ। সঠিক নেতৃত্বহীন ও দিকহারা হয়ে যায় লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ। অযোগ্য, অসৎ, মানবিক গুণহীন মানুষের কাছে চলে যায় দেশের নেতৃত্ব। শুরু হয় মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। তবে তখনো বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা নামে আশার আলো নিভু নিভু প্রদীপের মতো জ্বলছিল। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশে থাকার কারণে ঘাতকদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান। এটি ছিল আল্লাহর অশেষ রহমত।
বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন একটি স্বাধীন দেশ। আর ওই দেশকে সবদিক দিয়ে পুনর্গঠনসহ বাংলার মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তিদান এবং উন্নত বাংলাদেশ গড়ার জন্যই মহান আল্লাহ বঙ্গবন্ধুর জ্যৈষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা ও কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশে ফিরে আসার পরও তাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করা হয়। তবে আল্লাহর অশেষ রহমতে খুনিদের ওই চেষ্টা বারবারই ব্যর্থ হয়েছে। এটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এর প্রমাণ প্রধানমন্ত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাওয়া আজকের বাংলাদেশ। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর কন্যা দেশের সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর পুনরায় বাংলাদেশকে স্বাধীনতার চেতনার পথে এগিয়ে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক ও শোষণহীন সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। বাংলাদেশের মানুষ পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিজেকে শিহরিত করার সুযোগ পায়। এ কারণেই বলেছি, শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের যেন দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জন। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের দিশাহারা জনগণ ফিরে পায় দিশা; বাংলাদেশ ফিরে পায় তার মূল স্রোতধারায় চলার গতি, সঠিক পথ, আপন ঠিকানা। এর প্রমাণ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া আজকের বাংলাদেশ।
এই দেশের জনগণ বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতেই বাংলাদেশ নিরাপদ। বাংলাদেশ পরিচালনায় তার নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। তিনি থাকলে পথ হারাবে না আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সঠিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তার নেতৃত্বের কারণেই বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে; বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে; শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসাসেবা, তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি, অবকাঠামো, কৃষিসহ সব ক্ষেত্রেই উন্নতি লাভ করেছে এবং সব বাধা অতিক্রম করে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যথার্থ বাস্তবায়ন ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ অবশ্যই একদিন উন্নত দেশে পরিণত হবে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যখন বিদেশে অবস্থান করছিলেন, তখন তাকে আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে নেতৃত্ব নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আওয়ামী লীগ নেতা ও জননেতা জিল্লুর রহমান, আবদুস সামাদ আজাদ, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আইভি রহমান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, আবদুল মালেক উকিলসহ অনেকে। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাকে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। বুকভরা অসীম শোককে ধারণ করে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনতে তার দুই শিশুসন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে ছোট বোন শেখ রেহানার কাছে রেখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফেরেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে প্রায় ৬ বছর ভারতে অবস্থান করেন। সব বাধা ও ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা ও জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে ফিরে এসেছিলেন। মুষলধারার বৃষ্টিবাদল উপেক্ষা করে সেদিন বিমানবন্দরে লাখো জনতা অপেক্ষা করছিল কখন আসবেন তাদের প্রাণের নেত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন বিমানবন্দরে মানুষ সেøাগান তুলেছিল- ‘ঝড় বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’; ‘পিতৃ হত্যার বদলা নিতে, লক্ষ ভাই বেঁচে আছে’; ‘শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’ ইত্যাদি।
দেশের মাটিতে পা দিয়ে লাখো জনতার সংবর্ধনায় আপ্লুত শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল- সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই।’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ^াসী কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিতেই হয়। মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।’
দেশে ফেরার পর জননেত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১৯৯৬-২০০১ ও ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১৯ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া ১১ বছরেরও বেশি সময় তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা।
বঙ্গবন্ধুকন্যা, প্রধানমন্ত্রী, গণতন্ত্রের মানসকন্যা ও দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর- এ জাতীয় মেগাপ্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে। বাস্তবায়ন হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু, চালু হয়েছে মেট্রোরেল, মহাকাশে উড়ছে বাংলাদেশের গর্ব বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- বাংলাদেশে যা ছিল এক সময় কল্পনাতীত।
পরিশেষে বলব, প্রতিটি ক্ষেত্রেই জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এবং এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা মহান আল্লাহতাআলার রহমতে তিনি যেন শতায়ুপ্রাপ্ত হন এবং অবশ্যই ২০৪১ সাল পর্যন্ত দেশ পরিচালনার সুযোগ পান। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেঁচে থাকলে এবং দেশ পরিচালনার সুযোগ পেলে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হবেই; বাংলাদেশের জনগণ হবে বিশ্বের বুকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী উন্নত দেশের সৌভাগ্যবান গর্বিত নাগরিক। তবে আগামীতে জাতীয় নির্বাচন। এ সময়টা মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের জন্য কঠিন এক চ্যালেঞ্জের। কারণ স্বাধীনতাবিরোধীরা আবারও তৎপর হয়েছে। তারা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের প্রশংসার পরিবর্তে দিনরাত বিষোদ্গার করে যাচ্ছে, জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা বলে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। এই স্বাধীনতাবিরোধীরা মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনগণের সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা, প্রধানমন্ত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের রুখতে হবে এবং চলমান অভাবনীয় উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশ স্বাধীন করার ঐহিত্যবাহী রাজনৈতিক দল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের বিজয় সুনিশ্চিত করতে হবে- এই হোক জননেত্রী শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ২০২৩-এর শপথ।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান : চেয়ারম্যান, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ ও কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়