দেলওয়ার হোসাইন :
যেখানে কয়েক বছর আগেও শিক্ষার নাম ছিলো না, যেখানের মানুষ অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলো, যে এলাকার মানুষ বিসিএস শব্দটির সাথে পরিচিত ছিলো না, বিসিএস শব্দ বুঝতেই না। আজ সেই অন্ধকারে আলোর ঝলকানি হয়ে এসেছেন শাহাব উদ্দীন সাইফুল।
বলছিলাম অজপাড়াগাঁয়ের আবদুল করিমের কনিষ্ঠ সন্তান শাহাব উদ্দীন সাইফুলের কথা। তার কল্যাণে ওই এলাকার মানুষ বিসিএস কি এখন খুব ভাল ভাবে বুঝতে শিখেছে। শাহাব উদ্দীন সাইফুল এখন এলাকাবাসীর আলো; তিনি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের এক অজপাড়াগাঁ মগকাটা গ্রামের বাসিন্দা।
এলাকার অধিকাংশ লোক লবণ চাষী ও মৎস্যজীবী। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের আবার শিক্ষা দীক্ষা। বর্ষায় ৫ কিলোমিটার কাঁদা পথ মাড়িয়ে উপজেলা সদরে উচ্চ বিদ্যালয়ে এসে ক্লাসে উপস্থিত হওয়া এ যেন অসম্ভব। এই অসম্ভব কে সম্ভব করে নিয়েছে অধ্যাবসায়ী শাহাব উদ্দিন সাইফুল। যিনি ৪১তম বিসিএসে সমবায় ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। যেখানে শিক্ষার আলো বেশ দেরিতে পৌঁছালেও শাহাব উদ্দীন সাইফুলের এ অর্জনে তাঁর পরিবার ছাড়িয়ে পুরো এলাকায়ই এখন আলোকিত করেছে।
প্রথম এসএসসি পাস যার হাত ধরে,তাও ২০১১ সালে, যিনি প্রথম প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে বিবিএ এমবিএ সম্পুর্ণ করে এলাকার মুখ উজ্জ্বল করেছে।
তাঁর সাথে কথা বলে জানতে পারি তাঁর সংগ্রামী জীবনের কথা, অদম্য স্পৃহা আর হার না মানা মানসিকতার কথা। শৈশব থেকে পড়াশোনায় অগ্রগামী ছিলেন শাহাব উদ্দীন সাইফুল ।
পেকুয়া সরকারি মডেল জিএমসি থেকে কৃতিত্বের সাথে জিপিএ-৫ পেয়ে চট্টগ্রাম সরকারি হাজি মুহাম্মদ মহসিন কলেজে ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ভর্তি হন। এইচএমএসতেও তাঁর সাফল্যের ধারা অব্যহত রাখেন এবং জিপিএ-৫ পায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৪-১৫ সেশনের ব্যবস্থাপনার ছাত্র ছিলেন।পড়াশোনা শেষ করে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন এবং পাশাপাশি বিসিএসের পড়াশোনাও চালিয়ে যান। করোনার অভিঘাতে শিক্ষা ব্যবস্থা একপ্রকার বন্ধ হয়ে যায়,দেড় বছরের অধিক সময় চাকরির পরীক্ষা বন্ধ থাকায় এক প্রকার হতাশাজনক অধ্যায় পার করে শিক্ষার্থীরা।
তবু তিনি দমে যাননি, করোনা পরবর্তী কঠিন সময়ে নিজেকে হারতে দেননি বরং আরো পুরোদমে নতুনভাবে পড়াশোনা শুরু করেন।
শাহাব উদ্দীন সাইফুল বলেন,পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত ফুটবল, ক্রিকেট খেলতেন এবং টিভি দেখা ও ঘুরে বেড়ানো তার প্রিয় শখ। তবে পড়াশোনাটা নিয়মিত করতেন।তাঁর সাফল্যের পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন তার পিতামাতা ও এলাকাবাসী। মাস্টার্স থেকে নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন। প্রতি রাতে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক খবরাখবর দেখতেন। তাঁর চিন্তা ভাবনা সব সমাজ ও এলাকাবাসী নিয়ে। পৃথিবীতে কেউ সহজে কোন কিছু পায়না, সব অর্জন করে নিতে হয়।পরিশ্রম ও সাধনা করতে হয়, মানুষের দোয়া লাগে। সৃষ্টিকর্তার হুকম লাগে। “মানুষ তাঁর স্বপ্নের সমান বড়”।
যারা চাকরির প্রস্তুতিতে নতুন তাঁদের জন্য বলেন,” কখনো বড় জিনিস দ্রুত পাওয়ার চেষ্টা করবেন না। পৃথিবীতে যত জিনিস সহজে পাওয়া যায় সেটা তত সহজে হারানোর ভয় থাকে। তাই সময় দিয়ে, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বিজয় চিনিয়ে নিতে হবে”।
তিনি জানান,সমাজের মানুষের মাঝে শিক্ষার গুরুত্ব বুঝানোর জন্য সর্বাত্বক চেষ্টা চালানো, ছেলেমেয়ে যারা পড়াশোনা করছে তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা, বিভিন্ন সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা, গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে শিক্ষার আলো ছড়ানোতে ভূমিকা রাখবেন।
এলাকার প্রবীন মুরুব্বী মাহবুব ফকির বলেন, আমাদের এলাকা ছিলো একেবারেই শিক্ষা থেকে দূরে। এ গ্রামে একজন বিসিএস ক্যাডার কি আমরা বুঝি না। তবে অনেকের মুখে শুনেছি বিসিএস ক্যাডার নাকি অনেক বড় অফিসার। আমরা তাকে পেয়ে ধন্য। হয়তো এর দেখাদেখি আমাদের সন্তানরা শিক্ষার দিকে এগিয়ে আসবে।
শাহাব উদ্দীন সাইফুলের পিতা আবদুল করিম মগকাটার পরিচিত মুখ,শৈশব থেকে পড়াশোনার প্রতি তাঁর বেশ আগ্রহ ছিলেন। পিতা মাতার আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বেশিদূর আগাতে পারেনি। তবে তাঁর ছেলে মেয়ের পড়াশোনার জন্য চেষ্টার কমতি ছিলনা। নিরন্তর প্রচেষ্টায় তাঁর ছোট সন্তান আজ বিসিএস ক্যাডার অফিসার, যিনি ৪১তম বিসিএসে সমবায় ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
সাইফুলের বাবা আবদুল করিম বলেন, আমার স্বপ্ন ছিল ছেলে তিনটাকে মানুষ করা,উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করা।বড় দুই ছেলে মাঝপথে পড়াশোনা বাদ দিলে ভীষণ কষ্ট পাই।অন্তত একজন ছেলে অফিসার হয়ে আমার সেই ক্ষত কিছুটা পুষিয়ে দিয়েছে। আমি তাকে সবসময় বলি নিজের জন্য নয়; মানুষের জন্য কাজ করো এবং সদাসর্বদা নিজেকে বিলিয়ে দিও মানুষের কল্যাণে।