বিডি প্রতিবেদক :
জিও ব্যাগেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে কক্সবাজার সৈকতের শত বছরের পুরোনো লাবণী পয়েন্টের বালিয়াড়ি। লঘুচাপের প্রভাবে গত তিনদিন ধরে বঙ্গোপসাগর চরম উত্তাল। স্বাভাবিকের চেয়ে দু’থেকে চার ফুট বাড়ছে জোয়ারের পানি। শুক্রবার পূর্ণিমার টানে জোয়ারের পানি বেড়েছে আরো প্রবল। বাড়ন্ত পানির ঢেউয়ের তোড়ে ক্রমে ভাঙ্গছে কক্সবাজার সৈকতের তীর। ঢেউয়ের ঝাঁপটায় ক্ষয়ে যাচ্ছে সৈকতের বালু।
সৈকতের ডায়াবেটিক পয়েন্ট থেকে কলাতলীর ডলফিন মোড় পর্যন্ত এলাকায় ঢেউয়ের তোড়ে বিভিন্ন এলাকার বালু সরে গেছে। এতে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে। এই ভাঙ্গনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে সৌন্দর্য হারাচ্ছে বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। ভাঙ্গনের কবলে সাগরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি, ঝাউগাছের সারি। ঢেউয়ের তোড়ে ভাঙ্গনে কবলে রয়েছে সৈকতের লাবনী পয়েন্ট, জেলা প্রশাসন নির্মিত উন্মুক্ত মঞ্চ, সৈকতের ছাতা ও ঝিনুক মার্কেট। ভাঙ্গন আরো তীব্র হবার আতংকে রয়েছে পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। ডায়বেটিক পয়েন্ট হতে লাবণী পর্যন্ত জায়গায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বালু ভর্তি জিও টিউব দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করলেও প্রকৃতি এসব বাধা না মেনে ভাঙ্গন তীব্র করছে। বৃহস্পতিবার ঢেউয়ের তীব্রতা শুরু হলে লাবণী এলাকার উর্মি পয়েন্টে তীরেই ড্রেজার মেশিন বসিয়ে জিও ব্যাগে বালি ভরার হয়। এরপরই সেই অংশের ভাঙ্গন আরো তীব্র হয়েছে।
শুক্রবার (১২ আগস্ট) দুপুরে সৈকতের ভাঙ্গন এলাকাটি পরিদর্শন করেছেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির কিন আনোয়ার। এসময় ভাঙ্গন দেখতে আসা শহরের বাহারছরার বাসিন্দা বয়োবৃদ্ধ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ঝাউবন ও স্থাপণা রক্ষার নামে জিও ব্যাগ ভরতে তীরের ১০০ ফুটের মাথা থেকে তোলা হেয়েছে বালি। পরে জোয়ারের পানি এসে সেই গর্ত ডিঙিয়ে তলিয়ে নিয়ে গেছে জিও ব্যাগসহ তীর। পাউবোর দায়িত্বশীলরা সৈকতের আচরণ সম্পর্কে জ্ঞাত নয়। এখানে ঢেউয়ের মুখে বাঁধ দিলে তা ভাঙ্গন আরো তীব্র আকার ধারণ করে। ঢেউয়ের পানি স্বাভাবিক ভাবে আসা-যাওয়া করতে পারলে এত ভাঙ্গন হতো না। পাউবো ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের অদূরদর্শীতায় কিনার থেকে বালি তুলে ঢেউয়ের মুখে ঢালা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এটি অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের প্রধান আবহাওয়াবিদ আবদুল হামিদ মিয়া জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখানো হয়েছে। লঘুচাপের প্রভাবে সমুদ্র উত্তাল। উপকূলীয় এলাকায় মাঝারি বৃষ্টিপাত ও দমকা ঝড়ো হাওয়া চলছে। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৪ ফুট বাড়ছে। শুক্রবার পূর্ণিমার জোয়ারে আরো বেড়েছে পানি।
কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রেজাউল করিম বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুরে সৈকতের লাবণী পয়েন্টে উচ্চ জোয়ারের আঘাতে ঝুঁকির মুখে পড়ে ট্যুরিস্ট পুলিশের ডিউটি ঘর। আমরা দ্রæত ঘটনাস্থলে গিয়ে ঘরটি কোন মতে খুলে সাগরে বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা করেছি।
লাবণী পয়েন্টে দায়িত্বরত লাইফ গার্ড কর্মী ওসমান বলেন, এত উচ্চতায় জোয়ার বিগত বছরগুলোতে দেখিনি। সৈকতের কবিতা চত্বর পয়েন্ট থেকে কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত বালিয়াড়ি ভাঙ্গছে। ঝুঁকির মুখে পড়েছে নানা স্থাপনা। সৌন্দর্যহীন হয়ে পড়ছে সৈকত। ঢেউয়ের তোড়ে ওয়াকওয়ের ইট উঠে গিয়ে এলোমেলো হওয়ায় সৈকতে নামতে গিয়ে আহত হচ্ছেন পর্যটকরা।
স্থানীয়রা জানান, সুদীর্ঘকাল হতে বর্ষায় সাগরে পানি বৃদ্ধি পায়। তবে ভাঙ্গন এরকম তীব্র হতো না। বোদ্ধাদের মতে কক্সবাজারের বালুকাময় সৈকতে কোন ধরনের স্থাপনা গ্রহণযোগ্য নয়। নাজিরারটেক থেকে ইনানী পর্যন্ত বালুকাময় সৈকতে যেকোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা হলে সাগর ফুঁসে ওঠে। অতীতে এরকম অনেক নজির দেখা গেছে। কক্সবাজার সৈকত এবং দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) ঘোষণা করে যে কোনো বহুতল ভবন নির্মাণে রয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা। এই নিষিদ্ধ এলাকায় যে সকল বহুতল সুরম্য অট্টালিকা নির্মিত হয়েছে এগুলো ভেঙে ফেলার নির্দেশনাও কার্যকর হচ্ছে না।
কক্সবাজারের তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইসের পরিচালক আবদুল কাদের মিশু বলেন, সৈকতের এই ভাঙ্গন আতংকের। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী। এছাড়াও সেনাবাহিনী হিমছড়ি এলাকায় ভাঙ্গন রোধে যে ট্রিট্টা ব্যবহার করেছে এখানেও তা ব্যবহার করা যায় কিনা সম্ভাব্যতা যাচাই করা যেতে পারে। সেনাবাহিনী এটা ব্যবহারে সফল হয়েছে।
সুগন্ধা পয়েন্ট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, বিশ্বের দীর্ঘত সৈকতের শহর কক্সবাজার শুধু চিত্ত বিনোদনের প্রাণ কেন্দ্র নয়; বিশ্বের অন্যতম স্বাস্থ্যকর স্থানও। কক্সবাজারে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগমণ বাড়াতে রেল লাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। অথচ সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যভর সৈকত হুমকির মুখে। দেশের জাতীয় ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা কক্সবাজার সৈকত রক্ষার দাবি সবার। সমুদ্র সৈকত ঘিরে নানা কার্যক্রমে হাজারো কর্মসংস্থান হয়েছে। সমুদ্র সৈকত ধ্বংস হলে দেশের পর্যটন শিল্প ধ্বংসের পাশাপাশি এসব কর্মজীবীদের জীবনেও বিপর্যয় নেমে আসবে।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড’র নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ বলেন, গত কয়েক বছর ধরে সৈকতে ডায়বেটিক পয়েন্ট থেকে কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত বর্ষায় ভাঙনের কবলে পড়ছে। তা রোধে প্রাথমিকভাবে সৈকতের কবিতা চত্বর পয়েন্ট থেকে লাবণী পয়েন্টের কিছু অংশ জিও ব্যাগ বসানো হয়েছে।