কক্সবাজারে প্রতি হাজারে ২২ জন প্রতিবন্ধি

নিউজ রুম / ৩৫ বার পড়ছে
আপলোড : বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৫:৪২ পূর্বাহ্ন

হাকিম লোকমান :

জন্মের দেড় বছর পর ওয়াজিহান চৌধুরীর (৮) ধরা পড়ে মাইল্ড অটিজম। এ নিয়ে তাঁর মা রুশ্মিনা ইসলামের দুঃশ্চিন্তার কমতি ছিল না। মো. আদনান (১০) সেরিব্রাল পালস প্রতিবন্ধী হওয়ায় আরেফা বেগমের জীবনে ঝেঁকে বসেছিল হতাশা। মো. তামিম (১৩) সেরিব্রাল পালস হবেন ভাবতে পারেননি সাবিনা আক্তার। এ কারণে তাঁর অনেক খারাপ লেগেছিল।


এই তিন জনের মধ্যে- আদনান ডাক্তার, ওয়াজিহান দৌঁড়বিদ, তামিম ইঞ্জিনিয়ার হবেন এমন স্বপ্ন দেখেন মায়েরা। তারা সকলেই প্রতিবন্ধী শিশু। কক্সবাজার অরুণোদয় স্কুলের শিক্ষার্থী।
গত রোববার (৩০ নভেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টার অরুণোদয় স্কুলে আলাপচারিতায় ওয়াজিহানের মা রুশ্মিনা ইসলাম বলেন, ‘আমার ছেলে দৌঁড়াতে অনেক পছন্দ করে। ভবিষ্যতে দৌড়বিদ হয়ে অলিম্পিকের মতো জায়গায় দৌঁড়াবে এটাই আমার স্বপ্ন।’ আরেফা বেগম বলেন, ‘আদনানকে ডাক্তার বানাতে চাই। তাই রুটিন মাফিক স্কুলে নিয়ে আসি। এখানে এলে মন হালকা হয়।’

কোন প্রতিবন্ধি কতজন
‘প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ কমসূচি’র হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, কক্সবাজারে অটিজম ১২৭৮ জন, শারীরিক ২৪ হাজার ২৯১ জন, দীঘস্থায়ী মানসিক অসুস্থতাজনিত ২১৪৩ জন, দৃষ্টি ৬ হাজার ৫১৪ জন, বাক ৩ হাজার ৪৭৫ জন, বুদ্ধি ২২২৮ জন, শ্রবণ ১৬৬৬ জন, শ্রবণদৃষ্টি ২৩৬ জন, সেরিব্রালপালসি ১২৫৪ জন, বহুমাত্রিক ২৭৯৫ জন, ডাউন সিনড্রম ৭৪ জন, অন্যান্য ২৮৩ জন।

উপজেলাভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, নয় উপজেলার মধ্যে উখিয়ায় সবচেয়ে ১ দশমিক ৬২ শতাংশ। অপরদিকে কুতুবদিয়ায় সবনিম্ন ১ দশমিক ১৭ শতাংশ। জাতীয় পযায়ে এ হার ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
এসভিআরএস-২০২৩ প্রতিবেদনে জন্মগত কারণ, সড়ক দুর্ঘটনা, দুর্যোগ-সংক্রান্ত দুর্ঘটনা, অন্যান্য দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, বাধক্য, ভুল চিকিৎসাকে প্রতিবন্ধিতার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। তবে জরিপে প্রতিবন্ধিতায় সবচেয়ে সুস্পষ্ট কারণ অসুস্থতার সঙ্গে যুক্ত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ প্রতিবন্ধিতার জন্য অসুস্থতা দায়ী। এর পরে ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ বংশগত/বৈবাহিক/জন্মগত কারণ প্রতিবন্ধিতার জন্য দায়ী।
জানতে চাইলে জেলা সিভিল সার্জন আসিফ আহমেদ হাওলাদার বলেন,‘ নানা কারণে প্রতিবন্ধিতার হার বাড়ছে। এ হার কমাতে স্বাস্থ্য বিভাগ গর্ভবতী নারীদের মানসিক ও শারিরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করছে। পাশাপাশি প্রতিবন্ধিতার শিকার ব্যক্তিদের যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।‘

তোমার ছেলে কথা বলে?’
স্বামী ওয়াহিদ আহমদ চৌধুরীর চাকুরির সুবাদে খুলনা-ঢাকার পর ২০২০ সালে কক্সবাজারে থিতু হন রুশ্মিনা ইসলাম। তাঁর একমাত্র সন্তান আট বছরের ওয়াজিহান চৌধুরী মাইল্ড অটিজমে আক্রান্ত। ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে চাকুরি ছেড়েছেন তিনি। রুশ্মিনা ইসলামের জীবনে মতে, যাদের বিশেষ বাচ্চা (প্রতিবন্ধী) আছে তাঁদের আছে তিক্ত অভিজ্ঞতা। এমনকি তাঁর সন্তানের আচরণে বিরক্ত হয়েছেন বাড়িওয়ালা। এ কারণে ছাড়তে হয়েছে বাসা।
তিনি বলেন, ‘১ বছর ৪ মাস বয়সে ওয়াজিহানের সিনড্রোম দেখা দেয়। ওর কথা কমে যাচ্ছিলো। যখন বুঝতে পারি, খুব খারাপ লেগেছে। যেদিন কক্সবাজার এসেছি, সেদিন মনকে বুঝিয়েছি সব দুঃখ-কষ্ট ঝেড়ে ফেলে সন্তানকে সময় দিতে হবে।’
রুশ্মিনা বলেন, খুলনায় কোয়ার্টারে থাকতাম। ওখানকার বাসিন্দারা রোজ জিজ্ঞেস করতো, ‘তোমার ছেলে কথা বলে?’ উত্তর দিতাম, ‘না’। পরদিন আবার জিজ্ঞেস করতো, ‘তোমার ছেলে কথা বলে? বিরক্ত হয়ে উত্তর দিতাম, ‘এক রাতের মধ্যেই কি একটা ছেলে কথা বলতে পারে।’

‘কক্সবাজারে প্রথম যে বাসায় উঠি সেই বাড়িওয়ালা আমার সন্তানের আচরণে বিরক্ত হতো। কারণ, ওয়াজিহান একটু দৌড়াদৌড়ি করতো,’ বলেন তিনি।

ভেতরেটা পুড়ছে আসমার…
রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ি চেইন্দার বাসিন্দা আসমা আক্তারের ১০ বছর বয়সী ছেলে সাফওয়ান আল মাহাদী। সে জন্মগতভাবে ডাউন সিনড্রোম প্রতিবন্ধি। আসমা আক্তার বলেন, ‘সাফওয়ান পশু-পাখিতে বেশি আসক্ত। বিভিন্ন জিনিস পকেটে ভরে রাখে। এসব দেখে আমার ভেতরটা পুড়ে যায়।’
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘ সাফওয়ানের বাবাদের ছয় ভাইয়ের যৌথ পরিবার। চার ভাই বিয়ে করেছে। সবার বাচ্চা সুস্থ, আমার ছেলে অসুস্থ। অনেক কষ্ট লাগে।
আশা করিনি এমন সন্তান জন্ম নেবে। এখন ওর প্রতি আলাদা নজর রাখি। ভবিষ্যতে ওকে স্বাভাবিক মানুষ দেখতে চাই।’
তুমি পাপ করেছো…
কক্সবাজার শহরের বৈদঘোনা এলাকার বাসিন্দা সাবিনা আক্তার-মোবারক আলীর দম্পত্তির ছোট ছেলে তামিম জন্মগত সেরিব্রাল পালস প্রতিবন্ধী। হাঁটতে গেলে পড়ে যেতো। তামিমের জন্মের পর পরিবার-প্রতিবেশীদের নানান কটু কথা শুনেছেন সাবিনা।

সাবিনা আক্তার বলেন, ‘আমার ঘরেই বলতো-‘তুমি কোনো পাপ’ করছো, না হয় এমন সন্তান জন্ম হলো কেন!’
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে আগে মাটিতে বসে হাঁটা-চলা করতো, এখন দাঁড়িয়ে হাঁটতে পারে। তাঁকে অনেক চিকিৎসা করিয়েছি, অনেকটা উন্নতি করেছে। সে এখন কথা বলে, পড়াশোনা করে, গান গায়। মনকে সান্ত্বনা দিই-‘অন্যের চেয়ে আমি ভালো আছি।’

অরুণোদয়ে যুক্ত হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা
প্রতিবন্ধি শিশুদের জন্য ২০১৯ সালে কক্সবাজার শহরের হিলটপ সার্কিট হাউসের নিচে গড়ে উঠে বিশেষায়িত স্কুল ‘অরুণোদয়’। ৯৯ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা করা স্কুলটিতে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৮৮ জন।
স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৯ জন শিক্ষক ও ৯ জন কর্মচারী একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি বিশেষ শিক্ষা, প্রাথমিক, প্রি-ভোকেশনাল ও থেরাপী শাখায় আই কন্টাক ডেভেলপমেন্ট, আট এন্ড ক্রাফট, গ্রুপ ওয়াক, প্রি-হ্যান্ড রাইটিং, মটর স্কিল, সামাজিক দক্ষতা, ভাষাগত দক্ষতা, আচরণ ব্যবস্থাপনা, খেলাধুলা, জ্ঞানগত দক্ষতা, নৃত্য ও গান, প্রি-ভোকেশনাল ও এডিএল মাকেটিং, নৈতিক শিক্ষা ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিশুদের দক্ষ করে গড়ে তুলছেন।

ইতিমধ্যে এই স্কুলের ১৫ বছরের উর্ধ্বের শিক্ষার্থীদের মূল শোত ধারায় সম্পৃক্ত করতে সেলাই, ব্লক বাটিক, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, মোবাইল সার্ভিসিং, বিউটি পার্লারসহ বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
অরুণোদয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক শাহজালাল বলেন, ‘ইতিমধ্যে প্রকল্পের ডিজাইন-ড্রয়িং শেষ। আশা করছি, শিগগিরই এনজিও-আইএনজির মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।’
প্রতিবন্ধিরা কী সুবিধা পায়
প্রতিবন্ধি ব্যক্তিদের নিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদপ্তর, প্রতিবন্ধি উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজিবিলিটি ট্রাস্ট্রের বিভিন্ন কর্মসূচি থাকলেও জেলা পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষা কিংবা পুনর্বাসন প্রকল্প কর্মসূচি নেই।
কক্সবাজার জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক হাসান মাসুদ বলেন, ‘প্রতিবন্ধিদের শনাক্ত করে তাদের সুবর্ণ নাগরিক কাড প্রদান করা হয়। কক্সবাজার ৩৯ হাজার প্রতিবন্ধি ভাতার অন্তর্ভুক্ত। তারা মাসে ৮৫০ টাকা ভাতা পায়। তবে এই ভাতা পর্যাপ্ত নয়। এর বাইরে বিভিন্ন স্তরে বৃত্তি দেওয়া হয়। জাতীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণ-পুনবাসনের উদ্যোগ আছে, জেলা পর্যায়ে সেই প্রকল্প নেই।’
এ ব্যাপারে কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, ‘প্রতিবন্ধিদের মূল স্রোতধারায় যুক্ত করতে সবার অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক এবং আচরণগত পরিবর্তন খুবই জরুরি। একই সাথে যোগ্যতা অনুযায়ী প্রতিবন্ধিদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অন্তর্ভুক্তি করতে হবে। কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করে আর্ত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ দিলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। কিন্তু সরকার যে ভাতা দিচ্ছে তা একদিনের খরচ।’


আরো বিভিন্ন বিভাগের খবর