বিডি ডেস্ক :
আজ জুলাই গণঅভ্যুত্থান তথা শেখ হাসিনার সরকারের পতনের এক বছর পূর্ণ হলো। ১৫ বছরের অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পর দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ একটি সত্যিকারের পরিবর্তনের আশা করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক বিভাজন, সংস্কারে ব্যর্থতা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আজ সেই স্বপ্ন অনেকটাই ভেঙে পড়েছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরা এ বিষয়ে এক বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে জুলাই অভ্যুত্থানে আন্দোলনের সূচনা, শেখ হাসিনার পতনের পর জনগণের আশা-প্রত্যাশা, সরকারের সংস্কারে ব্যর্থতা, রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার লড়াই, শেখ হাসিনার পতনের দিনে হাজার হাজার নিহত ও আহতদের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ১৫ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে ঢাকায় মিছিলে অংশ নিয়ে মাথায় আঘাত পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিদ্যার শিক্ষার্থী সিনথিয়া মেহরিন সকাল। ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলায় গুরুতর আহত হন তিনি—১০টি সেলাই, এমনকি সাময়িকভাবে স্মৃতিশক্তি হারান। এর পরদিন, ১৬ জুলাই, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ২৩ বছর বয়সী ছাত্র আবু সাঈদ। তার মাটিতে লুটিয়ে পড়ার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, যা হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন আন্দোলনের সূচনা ঘটায়।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়—স্কুল, কলেজ, এমনকি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও রাজপথে নেমে আসে। দমন-পীড়নের ভয় উপেক্ষা করে তরুণদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন অভিভাবক, শিক্ষক, নাগরিক সমাজের নানা স্তরের মানুষ। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীর মতো বিরোধী দলগুলোও বিক্ষোভে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়—ফলে গড়ে ওঠে এক নতুন রাজনৈতিক ঐক্যফ্রন্ট।
সকাল বলেন, “প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও ছাত্ররা সমর্থনে রাস্তায় নামে। তখন মনে হয়েছিল, সত্যিই একটা বড় পরিবর্তন আসছে।”
অবশেষে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, হাজার হাজার বিক্ষোভকারী ঢাকায় শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন ও কার্যালয়ে হামলা চালায়।
৭৭ বছর বয়সী হাসিনা সামরিক হেলিকপ্টারে পালিয়ে আশ্রয় নেন প্রতিবেশী ভারতেই, যেখানে বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধসহ নানা অভিযোগে বাংলাদেশের আদালতের একাধিক সমন থাকা সত্ত্বেও তিনি বিচারের মুখোমুখি হননি।
তবে, এক বছর পর সেই স্বপ্ন আর উদ্দীপনার জায়গায় আজ দেখা যাচ্ছে হতাশা ও বিভ্রান্তি। নতুন সরকার গঠন নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত রাজনৈতিক দলগুলো, সংস্কারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ এবং ক্ষমতার লোভে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা যেন আবারও উপেক্ষিত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, জবাবদিহিমূলক এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করা। তবে, জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও প্রত্যাশার যে শক্তিশালী ধারা গত বছর তৈরি হয়েছিল, সেটি এখনো নিভে যায়নি—বরং সময়ের অপেক্ষায় রয়েছে।
জাতিসংঘের মতে, হাসিনা যখন পালিয়ে যান, তখন পর্যন্ত ১,৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হন, যার বেশিরভাগই সরকারি বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায় এবং হাজার হাজার বিক্ষোভকারী আহত হন।
ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার
হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার তিন দিন পর, বিক্ষোভকারীরা ৮ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে। এই বছরের মে মাসে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগকে গত বছরের বিক্ষোভকারীদের হত্যার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেকোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিষিদ্ধ করে। দলের ছাত্র সংগঠন, ছাত্রলীগ, ২০২৪ সালের অক্টোবরে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে নিষিদ্ধ করা হয়।
মঙ্গলবার হাসিনার সরকারের পতনের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে, বাংলাদেশ যখন ২০২৪ সালের বিদ্রোহকে সংজ্ঞায়িত করেছিল, তখন সকাল বলেন, ঐক্য এবং আশার অনুভূতি হতাশার দিকে পরিচালিত করেছে।
আগামী বছর প্রত্যাশিত সাধারণ নির্বাচনের আগে ক্ষমতার জন্য লড়াই করা বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তারা বিপ্লব বিক্রি করছে।”
তবে সময় যত গড়িয়েছে, ততই ক্ষমতার লড়াই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ভুলে আবার নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে দেশজুড়ে অস্থিরতার নতুন মাত্রা পাচ্ছে।
বিক্ষোভের শহর এবং ভঙ্গুর নিরাপত্তা
ঢাকা এখন “বিক্ষোভের শহর” নামে পরিচিত। পুলিশ ও সেনাবাহিনী নিয়মিত টহল দিচ্ছে, যাদের হাতে রয়েছে গুলি চালানোর বিশেষ ক্ষমতা। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৭২ জন নিহত এবং ১,৬৭৭ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে একটি মানবাধিকার সংগঠন। এই সময়েই বিচারবহির্ভূত হত্যার ৮টি ঘটনাও নথিভুক্ত হয়েছে। একইসাথে, খুন, অপহরণ, নারী ও শিশু নির্যাতন, ডাকাতি—সব অপরাধই বেড়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এক উপ-কমিশনার বলেন, “প্রতিদিনই বিক্ষোভ সামলানো আমাদের প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।” আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “আগে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা স্থানীয় বিরোধ মীমাংসা করত। এখন সেই কাঠামো ভেঙে পড়ায় বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য গোষ্ঠী টেন্ডার ও বাজার নিয়ন্ত্রণে সংঘাতে জড়াচ্ছে।”
যদিও দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি টালমাটাল, তবে অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক বছরে ২৪ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ৩২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং অবৈধ অর্থপাচার রোধে কড়াকড়ির কারণে এই প্রবৃদ্ধি।
মুদ্রাস্ফীতিও কিছুটা কমেছে, ১১.৭ শতাংশ থেকে ৮.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে অর্থনৈতিক অস্থিরতা পুরোপুরি কাটেনি। প্রায় ৩০ শতাংশ তরুণ কর্মসংস্থানে নেই বা শিক্ষা নিচ্ছে না। একইসাথে, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পোশাক শিল্পে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ লাখো শ্রমিকের জীবিকাকে অনিশ্চয়তায় ফেলেছে।
ঢাকার এক রিকশাচালক মোহাম্মদ শাইনুর বলেন, “পরিস্থিতি ধীরে ধীরে ভালো হচ্ছে।” তবে বিক্ষোভে আহত গাজী বলেন, “আমি একটি হাত হারিয়েছি, কিন্তু আমার কোনও অনুশোচনা নেই। প্রয়োজনে জীবন দেব, যাতে দেশ সুশৃঙ্খলভাবে চলে—যেই ক্ষমতায় থাকুক না কেন।”
এক বছর পেরিয়ে গেলেও ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের উত্তরাধিকারী আজও স্পষ্ট নয়। অনেকেই বলছেন—এই আন্দোলন ইতিহাস, কিন্তু সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে গড়ে তোলা জরুরি।
প্রকৃত পরিবর্তন কি আসবে? নাকি এই বিপ্লবও দলীয় রাজনীতির পালাবদলের ফাঁদে আটকে যাবে? সময়ই দেবে উত্তর।