ফরিদুল আলম দেওয়ান :
এ যেন ঝুপড়ীর তলে কুঁড়েঘরে ঘোর অমাবস্যার অন্ধকারে আলাদিনের চেরাগ হাতে পূর্ণিমার চাঁদ এসে আলো জ্বেলে ঝলমল জোসনা ছড়িয়ে দেয়ার মত অবাক বিস্ময়কর গল্পের কথা। ছেলের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে বাড়ি ভিটার জায়গা বন্ধক দিয়ে দিনে এনে দিনে খাওয়া নিতান্ত ভূমিহীন গরিব অসহায় দিনমজুর রংমিস্ত্রির একমাত্র ছেলের পঞ্চম শ্রেণী থেকে এইচএসসি পর্যন্ত যার প্রতিটি ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফলে এমনকি প্রতিটি বিষয়েও গোল্ডেন এ প্লাস ছাড়া অন্য কোন ফলাফলই হয় না। প্রতিটি সেন্টার পরীক্ষায় সে বরাবরের মতোই জিপিএ-৫ পেয়েই চলছে। এবারের এইচএসসি’তেও সে পেয়েছে জিপিএ-৫ ।
গল্পের মতো সেই স্বর্ণবালকটি হচ্ছে মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের মোহরা কাটা গ্রামের দরিদ্র রংমিস্ত্রি জকির আলম ও রহিমা বেগমের একমাত্র পুত্র সন্তান মোঃ সাজ্জাদ হোসেন। মাদ্রাসা ও স্কুলের নবম শ্রেণীতে একই ক্লাস পড়া দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সাজ্জাদ বড়। ভূমিহীন বাবা জকির আলম রাজমিস্ত্রিদের সাথে রংমিস্ত্রির কাজ করে। মাত্র ৫ শতক বনবিভাগের সরকারি খাস জায়গার ঝুপড়ি ঘরে তাদের বসবাস। বাড়ির পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীতে ছেলে যখন জিপিএ-৫ পায় বাবা তখন ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রয়াস পায়। এরপর মহেশখালী আইল্যান্ড হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে জেএসসিতে ও গোল্ডেন এ প্লাস পায় সে। টানাপোড়েনের অভাবের সংসারে তিন ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ জগতে হিমশিম খেলেও ছেলেকে নিয়ে বুকে বিশাল স্বপ্ন লালন করে চলছে জকির। সে বার এসএসসি’তেও বরাবরের মতো অপ্রতিরোধ্য ভাবে গোল্ডেন এ প্লাস নেয় সাজ্জাদ। ছেলেকে কলেজে পড়ানোর সামর্থ্য না থাকলেও বাঁধ মানছিল না বাবা মা’র। এবার মনস্থ করল ছেলেকে শহরের কোন ভালো কলেজে ভর্তি করে পড়াবে। কিন্তু জকিরের জন্য এ যেন বামুন হয়ে চাঁদে হাত টানার মত বিষয়। অবশেষে ছেলের ভর্তির টাকা জোগাড় করতে ৫ শতকের বাড়ি ভিটাটির অর্ধেক জায়গা অন্যজনের কাছে বন্ধক রেখে টাকা নিয়ে ছেলেকে ভর্তি করান চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজে। স্কুল ও মাদ্রাসায় পড়া দুই মেয়ের দায়িত্ব বাবা ভাগ করে নিয়ে ছেলের লেখাপড়ার দায়িত্বে মাকে দিয়ে পাঠান চট্টগ্রাম শহরের ভাড়া বাসায়। এবার মা বাবার এক ফোঁটা ঘামের মূল্য বৃথা যেতে দেয়নি ছেলে সাজ্জাদ। ৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এবারের এইচএসসি’তে ও সে বরাবরের মতো গোল্ডেন এ প্লাস এর ফলাফল অর্জন করে।
সাজ্জাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহরাকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবুল হোছাইন জানান, সাজ্জাদ যখন আমাদের স্কুলের ছাত্র ছিল তখন তার ভিতরে লেখাপড়ার মনোযোগীতার অদ্ভুত একটা বিষয় লক্ষ্য করতাম। তখন আমরা শিক্ষকরা মন্তব্য করতাম এ ছেলে একদিন অপ্রতিরোধ মেধার স্বাক্ষর রাখবে।
অব্যাহত সাফল্যের প্রতিক্রিয়ায় সাজ্জাদ বলেন, ছোটবেলা থেকেই বরাবরের মতো চেষ্টা করতাম ভালো কিছু করার। পরিবার এবং আশেপাশের মানুষকে ভালো কিছু দেয়ার চেষ্টা করতাম সবসময়।আলহামদুলিল্লাহ আমি পেরেছি। পারিবারিক আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। আব্বু দিন মজুর। দিনে এনে দিনে খায়। কিন্তু ওনি আমাকে কখনো সেটা বুঝতে দেয়নি।পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়,মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের প্রতিটা শিক্ষাগুরু আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। ওনাদের ঋণ কখনো শোধ করতে পারবো না।
লেখাপড়া করে ভবিষ্যৎ কি স্বপ্ন দেখছেন এমন জিজ্ঞাসায় সে বলেন, আমার স্বপ্ন আকাশের মতো বিশাল। বরাবরের মতো বড়কিছুর স্বপ্ন দেখতেছি। Bangladesh University Of Engineering and Technology (BUET) এ চান্স পেয়ে মা বাবা এবং মহেশখালীর গর্বের কারণ হতে সকলের দোয়া চাই।