
ফরিদুল আলম দেওয়ান :
দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে মহেশখালী-কক্সবাজার নৌরুটে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হলো আধুনিক সি-ট্রাক সার্ভিস। শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ১১টায় নতুন এই যাত্রা শুরুর মধ্য দিয়ে মহেশখালীর মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থায় যুক্ত হলো এক নতুন দিগন্তের। এদিন কক্সবাজার শহরের ৬নং জেটিঘাট থেকে ছেড়ে আসা ২৫০ জনের অধিক যাত্রী নিয়ে সি-ট্রাকটি ১০ কিঃমিঃ সমুদ্রপথ মাত্র ৩৫ মিনিটের নির্ধারিত সময়েই মহেশখালী জেটি ঘাটে পৌঁছায়। সী-ট্রাকের যাত্রা শুরু উপলক্ষে যাত্রীরা হিসেবে উপস্থিত থাকা আন্দোলনকারীরা উচ্ছ্বাস আর আনন্দ উল্লাস এবং আশার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে নতুন এই অভিজ্ঞতা গ্রহণ করেন। এ সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (বন্দর) এ কে এম আরিফ উদ্দিন, যুগ্ম পরিচালক সবুর খান, উপপরিচালক (চট্টগ্রাম দপ্তর) মো. কামরুজ্জামান ও সহকারী পরিচালক মো. খায়রুজ্জামান প্রমুখ। বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, ২৫ এপ্রিল থেকে নিয়মিত যাতায়াত করবে সি–ট্রাকটি। যাত্রীপ্রতি ভাড়া নির্ধারণ হতে পারে সর্বোচ্চ ৪০ টাকা।
সী-ট্রাকটিতে যাত্রী হয়ে মহেশখালী আসা মহেশখালী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোঃ জয়নাল আবেদীন বলেন, প্রথমবারের মতো যাত্রী নিয়ে সি-ট্রাক ভিড়েছে মহেশখালীতে। স্থাপন করা হয়েছে পল্টুন। মহেশখালীর মানুষের উচ্ছ্বাস দেখে ভীষণ ভালো লাগছে। জনগণের দুর্ভোগ লাগব করতে আমরা সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসবো।
এ নিয়ে বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (প্রশাসন) একেএম আরিফ উদ্দিন বলেন, আজ থেকে কক্সবাজার মহেশখালী নৌপথে পরীক্ষামূলক সি-ট্রাক চালু হয়েছে। পরে অনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করবে।
নৌপথটিতে শতাধিক দ্রুতগতির নৌযান স্পিডবোট ও কয়েকটি কাঠের নৌকা ও লোহার ‘গামবোট’ যাত্রী নিয়ে চলাচল করে আসছে। স্পিডবোটে ১০ কিলোমিটারের নৌপথ পাড়ি দিতে সময় লাগে ৮-৯ মিনিট। আর কাঠের ট্রলার ও গামবোটের লাগে ৪০ মিনিট। সন্ধ্যা ছয়টার পর এই নৌপথে স্পিডবোট ও গামবোটের চলাচল বন্ধ থাকে। ১০ জন ধারণক্ষমতার স্পিডবোটের জনপ্রতি ভাড়া ৯০ টাকা, আর ৪০ জন ধারণক্ষমতার গামবোটে ভাড়া ৩০ টাকা করে।
পরীক্ষামূলক সি–ট্রাকের প্রথম যাত্রায় ছিলেন কক্সবাজারের মহেশখালীর বাসিন্দা এবং মৎস্য ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারক আবদুস শুক্কুর সি,আই,পি। তিনি বলেন, মহেশখালীর পাঁচ লাখ মানুষের দীর্ঘদিনের একটি দাবি পূরণ হলো সি–ট্রাক চালুর মাধ্যমে যাত্রী সাধারনের দুর্ভোগ লাঘব করা। এখন উত্তাল সাগর এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াতেও মহেশখালীর যাত্রীরা কক্সবাজার শহরে নিরাপদ ভাবে পারাপারের সুযোগ পাবেন। এর মধ্য দিয়ে মহেশখালীতে উৎপাদিত মিষ্টি পান, লবণ-চিংড়ির ন্যায্যমূল্য পাবেন। পর্যটকেরাও নিরাপদে মহেশখালী দ্বীপ ভ্রমণের সুযোগ পাবেন।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মহেশখালীতে একটি নির্ভরযোগ্য ফেরি বা সী-ট্রাক সার্ভিস চালুর দাবি জানিয়ে আসছিলেন দ্বীপবাসী। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে প্রতিদিন হাজারো মানুষ শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা ও প্রশাসনিক প্রয়োজন মেটাতে কক্সবাজার জেলা সদরে যাতায়াত করেন। কিন্তু নৌপথে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবহনের অভাবে বরাবরই জনদুর্ভোগ ছিল তীব্র। বিশেষ করে, দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ছোট ট্রলার, স্পিড বোট ও কাঠের নৌকায় যাতায়াত ছিল ঝুঁকিপূর্ণ ও জীবননাশের আশঙ্কাজনক।
গত বছর ৫ আগস্ট মহেশখালীতে ছাত্র জনতা ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত আন্দোলনের পর সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর নড়েচড়ে বসে। এরপরই বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সি-ট্রাক চালুর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়। পন্টুন স্থাপন, ঘাট উন্নয়ন এবং যাত্রার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পর অবশেষে পরীক্ষামূলকভাবে এটি চালু করা হয়।
সি-ট্রাক মূলত একটি মাঝারি আকারের, দ্রুতগামী ও সুরক্ষিত নৌযান, যা যাত্রী ও হালকা পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। এতে আধুনিক আসন ব্যবস্থা, নিরাপত্তামূলক ফ্লোটেশন যন্ত্রপাতি এবং ভারী ঢেউ প্রতিরোধে সক্ষম প্রযুক্তি যুক্ত থাকে। সি-ট্রাক চালুর ফলে বিশেষ করে অসুস্থ, শিশু, নারীদের যাতায়াতে নতুন স্বস্তি আসবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
ঘাটে উপস্থিত যাত্রী নাসরিন আক্তার বলেন, “আগে ট্রলার ধরে যেতে হতো, কখনও ভয়ে উঠতে চাইতাম না। আজকে এই ট্রাকে আসতে পেরে মনে হলো—এটাই চাই ছিলাম।” মহেশখালীর কলেজছাত্র মাহফুজুর রহমান বলেন, “আমাদের সময় বাঁচবে। ঝুঁকি কমবে। এটা এক বিশাল অগ্রগতি।” জেলে পরিবার থেকে আসা সত্তরোর্ধ্ব মকবুল হোসেন বলছিলেন, “জীবনের এই বয়সে এসে শান্তিতে যাওয়ার ব্যবস্থা পেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি।
বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (পরিচালনা) এ কে এম আরিফ উদ্দিন বলেন, “সি-ট্রাকটি আপাতত পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হচ্ছে। যাত্রীসেবা, নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণ শেষে খুব শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে এটি উদ্বোধন করা হবে।
মহেশখালী উপজেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, “দ্বীপবাসীর দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ লাঘবের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ এটি। আমরা চাই সেবা যেন সঠিকভাবে অব্যাহত থাকে এবং দালালমুক্ত, সুশৃঙ্খল নৌপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
এই রুটে সি-ট্রাক চলাচল চালু হলে শুধু যাত্রী নয়, পর্যটক এবং ব্যবসায়ীরাও আরও আগ্রহী হয়ে দ্বীপে আসবেন। পর্যটন সম্ভাবনাও বাড়বে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় গতি আসবে, পাশাপাশি দুর্যোগকালে দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ বাড়বে। তবে কয়েকজন সচেতন নাগরিক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, সঠিক তদারকি না থাকলে আবারও ঘাট ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি ভাড়া নির্ধারণ ও টিকিট ব্যবস্থা যেন জনবান্ধব হয়, সেই দিকেও নজর দিতে হবে। মহেশখালীর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকূলীয় দ্বীপে আধুনিক সি-ট্রাক চালু হওয়া নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে এই সম্ভাবনার পূর্ণ বাস্তবায়ন নির্ভর করবে এর রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা এবং জনগণের অংশগ্রহণের ওপর। সি-ট্রাক যেন কেবল পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আটকে না থাকে—এই প্রত্যাশাই এখন দ্বীপবাসীর মুখে মুখে।