ফরিদুল আলম দেওয়ান :
মহেশখালীর শাপলাপুর ইউনিয়নের পাহাড়ি জনপদ পুরো মিঠাছড়ি গ্রামের মানুষ এখন নিরব নিস্তব্ধ ও নির্বাক হয়ে পড়েছে। তারা কোন মতেই উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না যে, ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সের ৪ কিশোর যারা জীবনে কোনদিন মাছ ধরতে সাগরে যায়নি এমন কিশোরদের কারাই নিয়েছিল সাগরে, কেন ওই কিশোরদেরও হত্যা করা হলো, তারা কি জেলে না জলদস্যু এমন প্রশ্নের।
গত ২৩ এপ্রিল কক্সবাজারের বাঁকখালীর মোহনায় নাজিরাটেক সৈকতে ভেসে আসা ট্রলারের বরফ রাখার হিমাগার থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ১০ মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় মিলছিল ওই ৪ কিশোরের লাশও। নিতান্ত অসহায় খেটে খাওয়া দুস্থ পরিবারের ৪ কিশোরকে হারিয়ে কারো কারো পরিবারে চলছে বুকফাঁটা আর্তনাদ আবার কারো কারো পরিবারে চলছে নিস্তব্ধ বোবা কান্না।
নিহত ৪ কিশোররা হলেন, মহেশখালী উপজেলার শাপলাপুর ইউনিয়নের মিঠাছড়ি গ্রামের দেলোয়ার হোসেনের ছেলে সাইফুল ইসলাম (১৭), জাফর আলমের ছেলে সওকত উল্লাহ (১৭), মুছা আলীর ছেলে ওসমাণ গনি (১৩), ও মোহাম্মদ আলীর ছেলে পারভেজ মোশাররফ (১৩)। মিঠাছড়ি গ্রামের অধিকাংশ মানুষের দাবি যে ছেলেগুলো জীবনেও সাগরে যায়নি এবং যাদের পেশা মাছ ধরা নয় ওই ৪ কিশোরকে কারা নিয়েছিল সাগরে, তারা কি জেলে না জলদস্যু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যেন তদন্ত করে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করে।
২৫ এপ্রিল বিকেলে শাপলাপুরের মিঠাছড়ি গ্রামে নিহত ৬ জনের বাড়িতে সরজমিনে খোঁজখবর নিতে গিয়ে দেখা যায়,
প্রধান সড়ক থেকে গ্রামে ঢুকতেই সামনের একটি কবরস্থানে সদ্য লাশ দাফনকৃত তিনটি নতুন কবরের মাঝখানে মধ্য বয়সি এক লোক নির্বাক হয়ে বসে বসে কবরের ঘেরা দিচ্ছিল। কবরের পাশে বেশ কজন সাংবাদিক গেলেও কারো দিকে তার ব্রুক্ষেপ নেই। জানতে চাইলে বলেন, উনার নাম মুছা আলী। ওইটা তার কিশোর ছেলে ওসমান গনির কবর। সাগর থেকে উদ্ধারকৃত ১০ মরদেহের সাথে তার ছেলের লাশ পাওয়া গেছে। বোবা কান্নায় ক্ষীণ কণ্ঠে বললো, আমার ছেলের বয়স ১৩ বছর পূর্ণ হয়নি। ২০১২ সালে তার জন্ম। জীবনে কোনদিন সাগরে মাছ ধরতে যায়নি। শাপলাপুর বাজারে এনজিওর দেওয়া কম্পিউটার নিয়ে ফ্যাক্সের দোকান করতো।
সে সহ আরো ৩ কিশোর যে সাগরে মাছ ধরতে যাবে ওই বিষয়ে পরিবারের কাউকে কিছু জানায়নি তারা। গত ৭ এপ্রিল (শুক্রবার) সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি কেউ। পরে লোকমুখে শুনেছি তাদের সাগরে মেরে ফেলা হয়েছে। আমার ছেলেকেও জলদস্যু বলায় আমি লাশ আনতে যাইনি লজ্জায়। তার মা তার লাশ শনাক্ত করে নিয়ে এসেছে। একই সাথে নিয়ে গিয়েছিল তার ভগ্নিপতি আমার মেয়ের জামাই শওকত উল্লাহকে। বিগত দুই মাস আগে তার সাথে আমার মেয়ে কিসমত আরা বেগমের। সেও মারা গেছে এ ঘটনায়।তাদেরকে আমার একই গ্রামের মোঃ হোসেনের পুত্র নুরুল কোভিদ ডেকে নিয়ে গিয়েছিল সাগরে। । আমি দিনমজুরি করে সংসার চালাই। ছেলে ও জামাতাকে হারিয়ে আমার সংসারে নেমে এসেছে ঘোর অমানিশার অন্ধকার। আমি ছেলে ও জামাতা হত্যার বিচার চাই।
নিহত অন্যান্য কিশোরদের স্বজনদের দাবি ওই গ্রামের মুহাম্মদ হোসেনের ছেলে নুরুল কবির (৩৫) প্রলোভন দিয়ে তাদের সন্তানদের সাগরে মাছ ধরতে নিয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে ঈদের খরচ জোগাতে তারা সাগরে মাছ ধরতে যায় আর সেখানেই ডাকাত সন্দেহে সবাইকে হত্যা করেছে। একই সঙ্গে তাদেরকে দেখে নিয়ে যাওয়া নুরুল কবিরের মরদেহও উদ্ধার হয়েছে একই ট্রলার থেকে।
মহেশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ প্রণব চৌধুরী বলেন, নিহতদের মধ্যে ৪ কিশোরের বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা বা অভিযোগের রেকর্ড নেই। তবে নিহত নুরুল কবিরের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে অস্ত্র ও ডাকাতির প্রস্তুতির দুটি মামলা এবং নিহত শামসুল আলম মাঝির বিরুদ্ধে একটি মাদক ও একটি ডাকাতির মামলা রয়েছে।