বিডি প্রতিবেদক :
কক্সবাজারের নাজিরারটেক উপকূলে ট্রলার থেকে ১০ মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আরও এক আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ নিয়ে মামলাটিতে এ পর্যন্ত ৪ আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
নিজেকে ডাকাত স্বীকার করে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় (৪ মে) চকরিয়ার বদরখালী এলাকার মো. নুর নবীর ছেলে গিয়াস উদ্দিন মুনির নামের এক সন্দিগ্ধ আসামী কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আসাদ উদ্দিন মো. আসিফের আদালতে বিকাল ৪ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত দীর্ঘ ৫ ঘন্টা ব্যাপি জবানবন্দী প্রদান করেন।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মুনীর বলেন, ট্রলার থেকে মৃতদেহ উদ্ধার হওয়া ১০ জনই ডাকাত ( জলদূস্য) ছিলেন। মহেশখালী পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর খায়ের হোসেন ও উপজেলার কুতুবজুম ইউনিয়নের সোনাদিয়ার মো. মোস্তফার ছেলে সুমন (২৭) এর নির্দেশনায় তারা পরিকল্পিত ভাবেই সাগরে জেলের বেশে নানা সময় ডাকাতি (দস্যুতা) করার উদ্দেশ্যে যেতেন । এই ১০ ডাকাতের মধ্যে নিহত চকরিয়া উপজেলার কোনাখালী ইউনিয়নের কবির হোসাইনের ছেলে সাইফুল ইসলামকে মুনীরই সাগরে
জলদূস্যতা করতে পাঠিয়েছিলেন।
এবিষয়ে মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা এবং কক্সবাজার সদর মডেল থানার পরিদর্শক দুর্জয় বিশ্বাস বলেন, ট্রলার থেকে ১০ মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪ জন আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন। তবে তাঁরা জবানবন্দীতে কি বলেছেন এখনো আমি জানি না।
কিন্তু আসামী মুনিরের কাছ থেকে রিমান্ডের সময় পুলিশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে। সেই তথ্যে মামলাটি একটি গতি পথ পেয়েছে। তবে এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হতে আরো সময়ের দরকার রয়েছে।
পুলিশ, আদালত সহ এ মামলায় সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে , আসামি মুনির প্রদত্ত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন,
তিনি একজন লবন চাষী। মূলত অন্যের জমিতে লবন তোলার কাজ করে। তিনি ছোট বেলা
থেকেই এই কাজ করছে। তবে কাজ কাম না থাকলে অভাবের তাড়নায় সাগরে ডাকাতি যান তিনি মাঝেমধ্যে। তিনি ৪-৫ বছর ধরে ডাকাতি করে আসছে। তিনি বহু ডাকাতি করেছে জানিয় বলেছেন তার হাত ধরে অনেক মানুষ ডাকাতিতে নেমেছে।
এমনকি কত ডাকাতি করেছে তা তার মনে নেই।
তবে কিছু ডাকাতির কথা মনে আছে জানিয়ে মুনির জবানবন্দীতে বলেন, ২০২১ সালে সোনাদিয়ার সুমন ও জনৈক মঞ্জুর, ট্রলারে নিহত শমসু মাঝি সহ কয়েকটি ডাকাতি আমরা করেছি। আমরা মূলত রাতের বেলায় ডাকাতি করি। রাতের বেলা ডাকাতি করে আমরা সাধারণ যে বোটগুলো দেখি সেসব থেকে মাছ, জাল, মোবাইল ইত্যাদি নিয়ে নেই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রেফতারকৃত গিয়াস উদ্দিন মুনির আদালতে জবানবন্দী প্রধানকালে তার পূর্বের ডাকাতির ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন,কিছুদিন আগে সম্ভবত গত মাসের ২য় রমজানের দিন সুমনের কথামত আমি, নুরুল কবির (বর্তমানে ডাকাতির ঘটনায় মৃত), সাইফুল ইসলাম পুতু (বর্তমানে ডাকাতির ঘটনায় মৃত) সহ কক্সবাজার আরো ৪ জন এবং মহেশখালীর পৌরসভার ৯ নং ওয়িার্ডের কমিশনার খায়েরহোসেন এর ৭ জন ডাকাত নিয়ে কমিশনার খায়ের হোসেনের ট্রলার ( যার নাম মায়ের
দোয়া ) নিয়ে আমরা অনুমান রাত প্রায় ১০-১১ টা বাজে ডাকাতি করতে বের হই। আমরা ঐদিন নুর করিম প্রকাশ নুকুরি ডাকে এমন নামের এক ব্যাক্তির বোট ডাকাতি করি।আমরা বোট থেকে মাছ পায়নি তবে বোট থেকে জাল নিয়েছি, ১ ব্যারেল তেল, মোবাইল ৫-৬ টি নিয়েছি। এরপর ঐ রাতে আরেকটি বোট ডাকাতি করেছি। ঐ বোট থেকে ৫০০-৬০০ পিস ইলিশ
মাছ আর ৫-৬ টি মোবাইল ডাকাতি করেছি। আমরা তখনো জানতাম না এই ডাকাতির অন্যতম
হোতা কমিশনার খায়ের হোসেন। আমরা ডাকাতি করে যখন নাজিরার টেকে আসি তখন খায়ের
হোসেন এবং সুমন একটি বোট নিয়ে আমাদের ডাকাতির সমস্ত কিছু নিজেদের বোটে করে নিয়ে যায়। তখন জানতে পারি আমাদের দিয়ে এই ডাকাতি করিয়েছে সুমন এবং খায়ের হোসেন। ডাকাতির কারণে আমাকে ৮ হাজার টাকা দিয়েছে। এই ডাকাতিতে সাইফুল ইসলাম পুতু (বর্তমানে ডাকাতির ঘটনায় মৃত)কে আমি নিয়ে যায়। এটা আমার সাথে সাইফুলের প্রথম ডাকাতি।
ট্রলার থেকে ১০ লাশ উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে গিয়াস উদ্দিন মুনির তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আরো বলেছেন,
যেদিন সমুদ্রে ১০ জন ডাকাতকে মেরে ফেলেছে তার দুই দিন আগে আমাকে নুরুল কবির ( ট্রলারে নিহত) এবং
সুমন ফোন দিয়ে ডাকাতির জন্য অনুরোধ করেছে। আমি প্রথমে রাজি হয়েছি ডাকাতির জন্য যাব
এই ভেবে। পরবর্তীতে আমি যে লবনের মাঠে কাজ করি সেই লবনের মাঠে কাজের চাপ আছে বলে আমি পরে ডাকাতি করতে যাব না বলে সুমনকে জানায়। আমি আর ঐ ডাকাতিতে যাইনি।
ঘটনা যেদিন সংঘটিত হয়েছে তার দুই একদিন পর মানুষের কাছ থেকে শুনেছি সমদ্রে ডাকাতি করতে গিয়ে কিছু ডাকাতকে মেরে ফেলেছে। তারপর ঘটনার ৪/৫ দিন পর আমি সুমনের মোবাইল নম্বরে ফোন দেই। অনেকবার সুমনের সাথে কথা
হয়েছে। আমি সুমনকে বলি একটা ঘটনা শুনেছি যে সমুদ্রে অনেক মানুষ মেরে ফেলেছে এটা কি সত্য নাকি। তখন সুমন বলে আমি তাদেরকে মরে যেতে সাগরে ডাকাতি করতে পাঠায়নি। আমি পাঠিয়েছি তাদের তারা যেন ডাকাতি করে কিছু টাকা ইনকাম করতে পারে। তারা টাকা দিয়ে মৃত্যু কিনেছে। এটা তাদের দোষ। তাদের যারা মেরেছে তাদের শাস্তি হবে আমার কি। আমি কি
মেরেছি নাকি। আমি ডাকাতি করতে পাঠিয়েছি। তারা শহীদ হয়েছে। রমজান মাসে এত সুন্দর
মৃত্যু কার হতে পারে। তখন আমি বুঝে গেছি নুরুল কবির, সাইফুল ইসলামদের মেরে ফেলেছে।
আমি গেলে আমাকেও মরে যেতে হত। আমি ডাকাত এটা সত্য। আমি সাইফুল ইসলামকে প্রথম ডাকাতিতে নিয়ে গেছি। তবে আমার সাথে সুমনের ফোনে কথা হয়ে যা জানলাম যারা মারা গেছে তাদের সুমন ডাকাতি করতে নিয়ে
গেছে।
এবিষয়ে মহেশখালীর পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর খায়ের হোসেনকে কল দেওয়া হলে তিনি ফোন রিসিভ করে মহেশখালী থানার ওসির রুমে আছে জানিয়ে মুঠোফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে বারবার ফোন দেওয়া হলে তিনি আর ফোন রিসিভ করেননি।
প্রসঙ্গত, গত ২৩ এপ্রিল গুরা মিয়া নামের এক ব্যক্তির মালিকানাধিন একটি ট্রলার সাগরে ভাসমান থাকা নামবিহীন ট্রলারটিকে নাজিরারটেক উপক‚লে নিয়ে আসে। আর ওই ট্রলারের হিমঘরে হাত-পা বাঁধা ১০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ইতিমধ্যে উদ্ধার হওয়া ৬ জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করলেও মর্গে রয়ে গেছে ৪ জনের মরদেহ ও কংকালটি। ডিএনএ পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে এ ৫ জনের পরিচয়।