আহমদ গিয়াস:
পৃথিবীর রাসায়নিক ও ভৌতিক গঠন, বিবর্তন, এর গতি, প্রাকৃতিক খনিজ ও শক্তি সম্পদ নিয়ে অধ্যয়ন করে ভ‚-তত্ত¡ (geology)। বিজ্ঞানের এই শাখাটি আর্থ সায়েন্স (Earth science) ও প্লানেটারি সায়েন্স (Planetary science) নামেও পরিচিত। ভ‚-তত্ত¡ অনুযায়ী এই পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪৫৪ কোটি ৫০ লক্ষ বছর। সেই ইতিহাসকে উন্মোচন করতে ব্যবহার করা হয় শিলা রেকর্ড। এটি গবেষণাগারের বাইরে বাস্তব জগতের সাথে সম্পর্কিত এবং সমাজের প্রয়োজনের সাথে সরাসরি প্রাসঙ্গিক।
পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে এই পর্যন্ত বা আদি জলবায়ূ নিয়ে আলোচনা করে প্যালিওক্লাইমেটোলজি। আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জলবায়ূকে আরও ভালভাবে বোঝার জন্য অতীতে ঘটে যাওয়া জলবায়ূ পরিবর্তনের কারণগুলি চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন প্যালিওক্লাইমেটোলজিস্টরা। অনেকেই জলবায়ূ বিজ্ঞান বা ক্লাইমেটোলজিকে আবহাওয়াবিদ্যা বা মেটরোলজির সাথে গুলিয়ে ফেলেন। আবহাওয়াবিদ্যা বা মেটরোলজির কাজ হল আবহাওয়ার বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তা ফোর কাস্ট বা প্রচার করা।
পৃথিবীর অতীতের জলবায়ূগত আচরণ ও পরিবর্তনের প্রভাবে এর ভৌতিক কাঠামো ও প্রাণিজগতের বিবর্তনকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর বয়সকে নানা ভ‚-তাত্তি¡ক যুগে ভাগ করা হয়েছে। এরমধ্যে বড় যুগকে বলা হয়, ইয়োন বা ইয়োনথেম। তার চেয়ে ছোট যুগকে বলা হয় ইরা বা ইরাথেম। আর ইরার চেয়ে ছোট যুগ হল পিরিয়ড বা সিস্টেম, পিরিয়ড এর চেয়ে ছোট যুগ হল এপক্স বা সিরিজ এবং এরচেয়ে ছোট যুগ হল এইজ বা স্টেজ। কয়েকটি স্টেজ বা এইজ মিলে হয় এপক্স, কয়েকটি এপক্স মিলে হয় পিরিয়ড, কয়েকটি পিরিয়ড মিলে হয় ইরা এবং কয়েকটি ইরা মিলে হয় ইয়োন।
এই ভ‚-তাত্তি¡ক যুগগুলোর সময় বা কাল সৌর বছরের মতো নয়। একেকটি ভ‚-তাত্তি¡ক এইজ এর বয়স হতে পারে সৌর বছর অনুযায়ী কয়েক হাজার বছর থেকে কয়েক লাখ বছর পর্যন্ত। আবার একেকটি এপক্স বা সিরিজের বয়স হতে পারে কয়েক লাখ থেকে কয়েক কোটি বছর পর্যন্ত।
ভ‚-তাত্তি¡কভাবে পৃথিবীকে চারটি ইয়োন (Eon) বা বড়যুগে ভাগ করা হয়েছে। এরমধ্যে হ্যাডিয়ান ইয়োন যুগ অব্যাহত ছিল ৪শ কোটি বছর পর্যন্ত। এর পরের বড়যুগ আর্চিয়ন ইয়োন, যেটি অব্যাহত ছিল আড়াইশ কোটি বছর পর্যন্ত। এই আর্চিয়ন ইয়োনেই পৃথিবীতে প্রথম এককোষী প্রাণির আবির্ভাব ঘটে বলে ধারণা করা হয়। আর তৃতীয় বড়যুগ প্রোটোজোয়িক ইয়োনে আবির্ভাব ঘটে দ্বিকোষী প্রাণির। আর সর্বশেষ ভ‚-তাত্তি¡ক বড় যুগ হল ফ্যানারোজোয়িক ইয়োন; যাকে বলা হয় নতুন প্রাণের যুগ, যেটি শুরু হয়েছে আজ থেকে প্রায় ৫৪ কোটি ১০ লাখ বছর আগে এবং এখনও চলছে। এই ফ্যানারোজোয়িক ইয়োনে আবির্ভাব ঘটে বহুকোষী ও জটিল কোষের প্রাণির।
আবার চারটি ভ‚-তাত্তি¡ক যুগের প্রথম তিনটিকে একসঙ্গে ‘প্রি-ক্যাম্্িরয়ান পিরিয়ড’ ও বর্তমান ইয়োনকে ‘ক্যাম্্িরয়ান পিরিয়ড’ নামে অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশের পশ্চিমাংশ দিনাজপুর বগুড়া বøকটির তলদেশের স্তর ‘প্রি-ক্যাম্্িরয়ান পিরিয়ডে’ গড়ে ওঠেছে বলে ধারণা করা হয়। যেটি বর্তমানে মাটির নীচে, সী-লেভেলের নীচে রয়েছে। আর দেশের পূর্বাংশ; দক্ষিণ থেকে টেকনাফ- কক্সবাজার-চট্টগ্রাম হয়ে শেরপুর পর্যন্ত যে পাহাড়ী এলাকা রয়েছে, সেটি মায়োসিন-প্লায়োসিন এপক্স যুগে গড়ে ওঠেছে। আজ থেকে ২ কোটি ৩০ লাখ ৩০ হাজার বছর থেকে ৫৩ লাখ ৩৩ হাজার বছর পর্যন্ত সময়কে মায়োসিন এবং ২৫ লাখ ৮৮ হাজার বছর থেকে ৫৩ লাখ ৩৩ হাজার বছর পর্যন্ত সময়কে বলা হয় প্লায়োসিন। এছাড়া দেশের মাঝখানের ভ‚-খÐটার বয়স আরো নবীন, তবে তলদেশের বয়স নবীন নয়।
অতীতের জলবায়ূ পরিবর্তনের রেকর্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন সময় এই ভ‚-খÐের বেশির ভাগ ভ‚মি সামুদ্রিক আগ্রাসনে চলে যায়। আবার সমুদ্র দূরে সরে যেতে যেতে আন্দামান-নিকোবরের কাছাকাছি ৮-৯ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ পর্যন্ত চলে যায়।
গ্রিণহাউস যুগে সমুদ্র যখন সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায়, তখন তাকে বলা হয় থার্মাল ম্যাক্সিমাম। এসময় পৃথিবীর ৯২ ভাগ ভ‚-ভাগই পানিতে ডুবে যায়। আর বরফ যুগে সমুদ্রের পানি থাকে নিরক্ষরেখার মাত্র ১শ কিলোমিটার পর্যন্ত।
আজ থেকে ১১ হাজার ৭শ বছর সময় থেকে ২৫ লাখ ৮৮ হাজার বছর পর্যন্ত সময়কে বলা হয় মহা বরফের যুগ- যেটি প্লেস্টোসিন এপক্স নামে পরিচিত। আর এই যুগেই মানবজাতির আবির্ভাব ও বির্বতন ঘটেছে বলে ধারণা করেন আদি নৃ-তাত্তি¡ক, জীবাশ্মবিদ ও আদিপ্রতœতাত্তি¡করা।
লেখক : সাংবাদিক গবেষক