রতন কান্তি দে :
অপহরণকারী চক্রের অপহরণ ঘটনার গল্পটা যেভাবে শুরুঃ
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উখিয়া সার্কেল মোঃ রাসেল এ ঘটনার আদ্যপান্ত জানালেন, উখিয়ার ১৬ নং ক্যাম্পের এ/১ ব্লকের আবু জাফর ও রেহেনা বেগমের ৪ বছরের ছোট শিশু রায়হান সকাল ১১টার দিকে বাড়ির সামনে একটু দূরে অন্যান্য সহপাঠীদের নিয়ে খেলছিল।
অপহরণকারীরা আগে থেকেই ওত পেতেছিল। এরা ২০ টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এবং খাবার খাওয়ার কথা বলে ও শিশুকে ফুসলিয়ে সহপাঠীদের সহ লোক চক্ষুর আড়ালে নিয়ে যায়।এক পর্যায়ে টেকনাফের মোছনী ক্যাম্পের সি ব্লকের একেবারে পিছনে দুর্গম পাহাড়ি এলাকার গহীন জঙ্গলে নিয়ে যাই।
সেখানে একটি জুপড়ী ঘরে আটকে রেখে তার পিতা আবু জাফরের কাছে মুঠোফোনের মাধ্যমে দুই লাখ টাকা মুক্তিপন দাবি করে। হতদরিদ্র রোহিঙ্গা জাফর এটা শুনে পাগলের মত হয়ে পড়ে। এত টাকা কোত্থেকে জোগাড় করবে?
এদিকে অপহরণকারীরা টাকা দিতে না পারলে উক্ত শিশুকে হত্যা করে লাশ পাঠাবে বলে হুমকি দেয়।এক পর্যায়ে রায়হানকে শারীরিক নিষ্ঠুর, নির্মম নির্যাতন চালায়। শিশুর কান্নার রোদনা পিতা মাতা কে মুঠোফোন শোনায়।এতে জাফর ব্যাকুল হয়ে শেষ পর্যন্ত ধার কর্জ করে অপহনকারীদের ৪৫ হাজার টাকা দিতে সম্মত হয়। অপহরণকারী চক্র রাজি হচ্ছিল না। বুধবারের মধ্যে টাকা দিতে না পারলে ছেলের লাশ পাঠাবে বলে তাকে সাফ জানিয়ে দেয়।এতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার পরিবার।
বিষয়টি জানাজানি হলে এই চাঞ্চল্যকর খবরটি কক্সবাজারের পুলিশ সুপারের কাছে পৌঁছায়। তিনি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উখিয়া সার্কেল ও অফিসার ইনচার্জ ও উখিয়া কে শিশুটিকে উদ্ধারের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেন। তারা কাল বিলম্ব না করে জাফরের কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য ওখবরা-খবর নিয়ে জরুরী অ্যাকশনে নেমে পড়েন। অপরদিকে অপহরণকারীদের সাথে জাফরকে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার জন্য বলেন।
অপহরণকারীরা যাতে টের না পায় এএসপি ও ওসির নেতৃত্বে উখিয়া পুলিশের সুদক্ষ চৌকোস একটি দল শিশুটিকে উদ্ধারে জোর তৎপরতা শুরু করে।টানা দুদিন অভিনব কৌশল অবলম্বন করে ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী সাদেককে আটক করে। তার স্বীকারোক্তি মতে এবং উচ্চতর প্রযুক্তির মাধ্যমে ড্রোনের সাহায্যে অপহরণকারী সহ শিশুটির অবস্থান নিশ্চিত হয়।
অবশেষে শনিবার ভোর সকালে মুছনি ক্যাম্পের সি ব্লকের হোসেনের ঘরে মেধাগত সাহসী অভিযান পরিচালনা করে তার বোন অপহরণকারী চক্রের সদস্য রোকসান কাছে আটকে থাকা অবস্থায় শিশুটিকে উদ্ধার করে।পরবর্তীতে অপহরণকারীদের আরেক সহযোগী ফয়সালকে ও গ্রেফতার করে।
পুলিশের তড়িৎ তৎপরতা এবং কার্যকরী ভূমিকার কারণে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসল শিশু রায়হান। ছেলেকে ফিরে পেয়ে তার বাবা রোহিঙ্গা আবু জাফর ও মা রেহেনা বেগম আবেগ আপ্লুত হয়ে খুশিতে আত্ম হারা হয়ে পড়েন।
রবিবার ( ৩ সেপ্টেম্বর) থানায় এ ঘটনার প্রেস ব্রিফিং শেষে ছেলেকে কোলে নিয়ে যাওয়ার সময় আকাশ সমান খুশিও আনন্দে এক প্রতিক্রিয়ায় জানান হে আল্লাহ বাংলাদেশের হুকুমতে (সরকার) পুলিশ ভাইদের উসিলায় আমাদের ছেলেকে টাকা পয়সা ছাড়াই জীবিত ফিরে পেয়েছি। তাদের জন্য মন থেকে দোয়া করছি।হে আল্লাহ তাদের রহম করুন।
গ্রেপ্তারকৃত ৩ অপহরণকারীরা হলেন, টেকনাফের মোছনী রেজিষ্টার্ড ক্যাম্প-২৬ এর সি ব্লকের মো. আমিনের পুত্র সাদেক হোসাইন (২৫), ও তারই আপন বোন রোকসানা (১৫) এবং একই ক্যাম্পের দিল মোহাম্মদের পুত্র আমির ফয়সাল (২৩)। তাদের মধ্যে অপহরণ চক্রের মূল হোতা সাদেক হোসেন জামতলি বাজার সংলগ্ন জহুর আলমের বাসায় ভাড়া থাকতো।
রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) বেলা ১২টায় উখিয়া থানায় এক সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমকর্মীদের এসব তথ্য জানান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উখিয়া (সার্কেল) মো. রাসেল।তিনি আরো জানান এমতাবস্থায় কোনো উপায় না পেয়ে উখিয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন ভুক্তভোগীর মা রেহেনা বেগম।
এরপর তথ্য প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জড়িতদের গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্যে উখিয়া ও টেকনাফ থানার চৌকস আভিযানিক দল দুর্গম পাহাড়ে ঢালে বিভিন্ন ঝুপড়ী ঘরে শিশুটির সন্ধানে অভিযান পরিচালনা করা হয় এবং দিনের বেলা ড্রোনের মাধ্যমে পাহাড়ের উপর থেকে অনুসন্ধান করা হয় দুর্বৃত্তদের অবস্থান।
উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, রায়হানের বাবা-মা রোহিঙ্গাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ৪৫ হাজার টাকা ৭০০ টাকা মুক্তিপণ জোগাড় করে তাদের ছেলেটিকে উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু এই টাকায় তারা রায়হানকে ছেড়ে দিতে রাজিও হয়নি।
এদিকে, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা সম্পূর্ণ ঘটনা স্বীকার করেছেন।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উখিয়া সার্কেল আরও জানায় গ্রেফতারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে এরকম ঘটনা ঘটলে অপহরণকারী চক্রের বিরুদ্ধে পুলিশের কঠোর অবস্থান ওঅভিযান অব্যাহত থাকবে।
লেখক :
সাধারণ সম্পাদক
উখিয়া প্রেসক্লাব