শিরোনাম :
টেকনাফ উপজেলার হোয়াইকং ইউনিয়নে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১টি বাড়ি পুড়ে ছাই,ক্ষয়ক্ষতি ৪০ লাখ টাকা সেন্টমার্টিনে পর্যটক সীমিতকরণ এবং রাত্রিযাপন নিষিদ্ধের প্রতিবাদে মানববন্ধন ডাকাতের কবলে পড়ে মিয়ানমারের আরাকান আর্মির হেফাজতে থাকা ১৬ জেলে ফেরত এনেছে বিজিবি “১ টাকায় হাজার টাকার বাজার” নাফ নদীর মোহনায় স্পিডবোট ডুবি শিশু সহ ২ জন নিখোঁজ, জীবিত উদ্ধার-৮ কক্সবাজারে নাতনির স্বামীর হাতে নানী খুন বিকাশের দোকান চুরিতে ২লাখ ৭০হাজার টাকা উধাওঃব্যথার ওপর সংবাদকর্মী ব্যথা নৌবাহিনীর অভিযান : মাতারবাড়ি পাওয়ার প্ল্যান্টের চুরি হওয়া কোটি টাকার মালামাল জব্দ মালয়েশিয়া বলে ইনানী সৈকতে শতাধিক রোহিঙ্গাকে রেখে পালালো দালালরা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কক্সবাজারের অনেক এলাকায় খাবার পানির সংকট :ইয়াছমিন-রহিমার পানির দুঃখ ঘুচালো হাইসাওয়া

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কক্সবাজারের অনেক এলাকায় খাবার পানির সংকট :ইয়াছমিন-রহিমার পানির দুঃখ ঘুচালো হাইসাওয়া

নিউজ রুম / ১০ বার পড়ছে
আপলোড : শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:৪৬ পূর্বাহ্ন

সরওয়ার আজম মানিক :

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাবার পানির সংকট কক্সবাজার জেলায় দিন দিন বেড়েই চলছে। বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন, লবণাক্ত পানির প্রবাহ, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহ নানা কারণে এ সংকট তৈরি হচ্ছে। সংকটময় এই সময়ে মানুষকে নিরাপদে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেছে হাইসাওয়া নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। পরিবেশবিদদের মতে বৃষ্টির পানির সংরক্ষণ সহ এখনই জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
কক্সবাজারের ৮টি উপজেলাতে নিরাপদ খাবার পানির সংকট রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সে টি বেড়ে যাচ্ছে। অনেক এলাকায় টিউবওয়েল থাকলেও পানি উঠে না। আবার অনেক এলাকায় ময়লাযুক্ত পানির কারণে সেটি খাওয়া যায় না। ফলে কক্সবাজার জেলায় সুপেয় পানির সংকট লেগে আছে।


কক্সবাজারের রামুর চাকমারকুল ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব আহমেদ পাড়ার গৃহিনী ইয়াছমিন আক্তারের খাবার পানি সংগ্রহ করা ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এ নারীকে বেশির ভাগ সময় স্বামী মো. মোজাম্মেল এক-দেড় কিলোমিটার দূর থেকে পানি এনে দিতেন। তবে স্বামী জীবিকার খোঁজে বের হলে বাড়তো ইয়াছমিনের অসহায়ত্ব। বাধ্য হয়ে খাওয়াসহ দৈনন্দিন কাজ সারতেন পাশের বাড়ির নলকূপের ময়লা পানি দিয়ে।

ইয়াছমিনের বহুদিনের ইচ্ছে ছিল একটি গভীর নলকূপ স্থাপন করবেন। কিন্তু দিনমজুর স্বামীর সেই সামথ্য হয়ে উঠেনি। অবশেষে ইয়াছমিনের কষ্ট দূর করেছে বেসরকারি অলাভজনক সংস্থা-হাইসাওয়া।
ইয়াছমিন আক্তার ছাড়াও পাশ্ববতী রহিমা খাতুন, ফুলমতি বেগমসহ আরো ৫৫ পরিবারের পানির কষ্ট দূর হয়েছে। পরিবারগুলোকে পাইপলাইনের মাধ্যমে বাড়ির উঠোনে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেছে হাইসাওয়া। এ নিয়ে উপকারভোগীদের আনন্দের শেষ নেই। পানি ছাড়াও দরিদ্র পরিবারগুলোকে ‘পরিবারভিত্তিক উন্নত ল্যাট্রিন’ সুবিধার আওতায় এনেছে সংস্থাটি।

কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ঝিলংজা ইউনিয়নের শেষাংশে রামুর চাকমারকুল ইউনিয়নের শুরু। মহাসড়ক থেকে নেমে জারাইতলী সড়ক ধরে আধা কিলোমিটার গেলেই ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব আহমেদপাড়া। এলাকাটি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে অনেকটাই বিপর্যস্ত। ঘনবসতিপূণ এলাকাটি দরিদ্র মানুষের সুপেয় পানি, স্যানিটেশনসহ উন্নত সেবা পাওয়া ছিল স্বপ্নের মতো।

হাইসাওয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল ওসমান জানান,ডেনমার্ক সরকারের আর্থিক সহায়তা ও স্থানীয় সরকার বিভাগের যৌথতায় প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে এই পানি সরবরাহ সেবা চালু করা হয়েছে। এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ‘কক্সবাজারে জলবায়ু ঝুঁকিপূণ মানুষের জন্য অভিযোজনমূলক প্রকল্প’। প্রকল্প ব্যয়ের ১০ শতাংশ অর্থাৎ দেড় লাখ টাকা দিয়েছেন স্থানীয় উপকারভোগীরা।

সরজমিনের চাকমারকুল পূর্ব আহমেদ পাড়া ঘুরে দেখা যায়, পাঁচ বছর মেয়াদী এ প্রকল্পের আওতায় স্থাপন করা হয়েছে ৮১০ ফুট গভীর নলকূপ, আধুনিক মোটর। অবকাঠামো তৈরী করে ২০ ফিট উঁচুতে বসানো হয়েছে ৫ হাজার লিটার ধারণক্ষমতার পানির ট্যাংক। পাইপলাইনের মাধ্যমে ইতিমধ্যে ৫৫টি পরিবার সরাসরি পানি পাচ্ছেন। পর্যায়ক্রমে ১০০ পরিবারকে এতে যুক্ত করা হবে। বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে এখানে বসানো হয়েছে সোলার প্যানেল।

আলাপকালে উপকারভোগী ইয়াছমিন আক্তার বলেন, ‘বাড়িতে নলকূপ স্থাপনের অনেক ইচ্ছে থাকলেও স্বামীর সামর্থ্য ছিল না। এখন পাইপলাইনে পানি পেয়ে অনেক ভালো লাগছে। সুন্দরভাবে জীবন যাপন করতে পারবো।’

আরেক উপকারভোগী রহিমা বেগম বলেন,‘ আগে এক কিলোমিটার দূর থেকে পানি আনতে হতো। সেখানেও ছিল লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার ভোগান্তি। এখন বাড়ির উঠোনে পানি পাচ্ছি আমাদের অনেক উপকার হয়েছে।’

ইউনিয়নটির সংরক্ষিত নারী সদস্য মরিয়ম বেগম বলেন, ‘ওয়ার্ডগুলো ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা বড় সমস্যা ছিল। হাইসাওয়ার এই প্রকল্পের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠী উপকৃত হচ্ছে। ইতিমধ্যে আরো তিনটি স্থাপনের জন্য আবেদন করেছি।’

হাইসাওয়ার রামু উপজেলা ওয়াশ অফিসার মোছাম্মৎ আন্না খাতুন বলেন ‘দূর থেকে পানি আনতে পুরুষেরা নারীদের সহযোগিতা করে না। অনেকে পুকুরের পানি ব্যবহার করতো, যা অস্বাস্থ্যকর। এখন ঘরে ঘরে পানি পাচ্ছে, এটা আরামদায়ক।’
কক্সবাজার নাগরিক ফরমের সভাপতি আ.ন.ম. হেলাল উদ্দিন বলেন,হাইসাওয়ার মতো অন্যান্য সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে সাধারণ মানুষের পানি সংকট মোকাবেলায়। তবে এখানে বড় ভূমিকা কিন্তু সরকারের। সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এ সংকট মোকাবেলা করতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ফাউন্ডেশনের সভাপতি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফরহাদ হোসেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কক্সবাজারের বৃষ্টিপাতের প্যাটার্ন পরিবর্তিত হচ্ছে, কম বৃষ্টি হলে জলাশয়ে পানির স্তর কমে যায়, সমুদ্রের স্তরের উত্থানের কারণে অঞ্চলে লবণাক্ত পানি প্রবাহিত হচ্ছে, যা পানির উৎসগুলিকে নষ্ট করছে। অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্টোর নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ সংকট আরো বেড়ে যায়। তাই কক্সবাজার সহ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সরকারের বড় ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরী।
হাইসাওয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল ওসমান বলেন, ‘কক্সবাজার ঘুর্ণিঝড়প্রবণ এলাকা। এ জেলায় সুপেয় পানির সংকট চোখে পড়ার মতো। উৎস কম থাকায় মানুষ বাধ্য হয়ে দূষিত পানি পান করেন। গভীর নলকূপ স্থাপনের খরচ বেশি হওয়ায় অনেক মানুষের পক্ষে তা স্থাপন সম্ভব হয় না। এ জন্য তাঁদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে হাইসাওয়া।’
কক্সবাজার সদরসহ টেকনাফ, উখিয়া এবং রামুতে সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন সেবাসহ নানান প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে হাইসাওয়া। জেলার চার উপজেলার ২১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় গত অর্থবছরে ৮০০টির বেশি পানির উৎস এবং ল্যাট্রিন নির্মাণ করেছে সংস্থাটি।
কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এম আনোয়ারুল হক বলেন, বৃষ্টির পানি সংগ্রহ, ভূগর্ভস্থ পানি সংরক্ষণ, জলধার ও পুকুর তৈরি, যেসব পুকুর রয়েছে সেগুলোকে সংরক্ষণ, সরকারি বেসরকারি নানা উদযোগ, মানুষকে সচেতন করা ও সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। সে সাথে গবেষণার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে বের করার উপর গুরুত্ব দেন নাগরিক ফোরামের এই নেতা।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রামু সহ কয়েকটি এলাকায় মানুষের সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে কাজ করছে হাইসাওয়া। তবে সরকার, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ , ভূগর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমানো সহ নানা উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানান।
তিনি বলেন, সরকার ইতিমধ্যে কক্সবাজার জেলার দশটি স্থান চিহ্নিত করে সেখানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে বলেও জানান তিনি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কক্সবাজার জেলায় পানির যে সংকট দেখা দিয়েছে তা নিয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কাজ করছে বলেও জানান তিনি।


আরো বিভিন্ন বিভাগের খবর