মুকুল কান্তি দাশ :
এক বুক স্বপ্ন নিয়ে তিন যুবক ফাঁড়ি জমিয়েছিলো প্রবাসে। কিন্তু তাদের স্বপ্ন আর পুরণ হলো না। তাদের স্বপ্ন এলো কফিনে বন্দি করে। এখন তাদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। তাদের পরিবারকে সমবেদনা জানানোর ভাষাও হারিয়ে ফেলেছে প্রতিবেশিরা।
যাদের কথা বলছিলাম তাদের সবার বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা যুবক মিজবাহ উদ্দীন (৩২), কৈয়ারবিল ইউনিয়নের আবদুল হালিম (৪২) ও কাকারা ইউনিয়নের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলমগীর (৩২)।
কথা ছিল একদিন তাঁরা কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করে দুবাই থেকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অবস্থা তৈরি করে দেশে ফিরবেন। কিন্তু তাঁরা ফিরেছেন ঠিকই, পরিবারের জন্য সম্পদ বা কাড়িকাড়ি টাকা নিয়ে নয়, তিনজনই ফিরছেন নিথর দেহে কফিন বন্দি হয়ে। তাতে ভেঙে চুরমার তাদের তিনটি পরিবারের অনাগত ভবিষ্যতের সুদুরপ্রসারি স্বপ্ন।
একমাসের বেশি সময় আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে (দুবাই) নিজ বাসার রুমে ঘুমন্ত অবস্থায় হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান মিজবাহ উদ্দীন। তিনি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ফাসিয়াখালী ইউনিয়নের রাজারবিল এলাকার মৃত দেলোয়ার হোসেনের ছেলে। একইভাবে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আজমানের একটি হাসপাতালে ভর্তি হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর কাছে হার মানেন উপজেলার কৈয়ারবিল ইউনিয়নের ভরইন্যারচর এলাকার আবদুল হাকিমের ছেলে আব্দুল হালিম। মৃত্যুর পর পরিবার সদস্যদের কাকুতি-মিনতির কারণে দুইজনের মরদেহ সেখানের হাসপাতালের হিমঘরে রেখে দেশে আনার যাবতীয় উদ্যাগ নেন চকরিয়া প্রবাসী ফোরাম ও প্রবাসী সোসাইটির নেতৃবৃন্দ।
এরই মধ্যে কিছুদিন পর সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাস-আল খাযমা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন উপজেলার কাকারা ইউনিয়নের মাইজকাকারা এলাকার আবদুল করিমের ছেলে যুবক মোহাম্মদ আলমগীর (৩২)। পরবর্তী প্রবাসী ফোরাম ও প্রবাসী সোসাইটির নেতৃবৃন্দ একসঙ্গে তিনজনের মরদেহ দেশে আনার জন্য কাজ শুরু করেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে (দুবাই) আইনী প্রক্রিয়া শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার ৩০ মার্চ সকালে দুবাই মারা যাওয়া চকরিয়া উপজেলার তিন প্রবাসী মিজবাহ উদ্দীন, আবদুল হালিম ও মোহাম্মদ আলমগীর এর মরদেহ চকরিয়ায় নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছে। এদিন দুপুর দুইটায় চকরিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তিনজনের নামাজে জানাজা একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদিন সন্ধ্যার দিকে সামাজিক কবর স্থানে তাদের দাফন করা হয়েছে।
তার আগে চকরিয়া প্রবাসী ফোরামের ব্যবস্থাপনায় ও চকরিয়া প্রবাসী সোসাইটি’র সার্বিক সহযোগিতায় সংযুক্ত আরব আমিরাত দুবাইয়ে বুধবার ২৯ মার্চ তাদের প্রথম নামাজে অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তিন রেমিটেন্স যোদ্ধার মৃতদেহ বাংলাদেশে গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়।
চকরিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাজায় উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ জাফর আলম, চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো.আবু মুছা, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন হেলালী, কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিন, প্রবাসী ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এসএম মিনার চৌধুরী, সহসভাপতি ইয়াসিন আরাফাতসহ স্থানীয় সাংবাদিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও প্রবাসী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও সকলস্থরের নাগরিক।
ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো.হেলাল উদ্দিন বলেন, মারা যাওয়া মিজবাহ উদ্দীন আমার ইউনিয়নের বাসিন্দা। তাদের পরিবার একসময় খুবই অসচ্ছল ছিল। ৫-৭ বছর আগে প্রথমে বড়ভাই মিনার ও পরে মিজবাহ দুবাই ফাঁড়ি জমালে আস্তে আস্তে তাদের পরিবারে সুদিন ফিরতে শুরু করে।
তিনি বলেন, এখন তাদের পরিবারটি এলাকায় ভালো অবস্থানে আছে। কিন্তু মিজবাহ উদ্দীনের অকালে এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে পরিবার সদস্যদের মাঝে একধরনের শুন্যতা নেমে এসেছে। কথা ছিল মিজবাহ এবছর বাড়ি ফিরে বিয়ের পীড়িতে বসবেন। কিন্তু নিয়তি তা আর হতে দিলনা।
প্রবাসী ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও মারা যাওয়া মিজবাহ উদ্দীনের ভাই এসএম মিনার চৌধুরী বলেন, প্রবাসে মৃত্যুবরণ করা চকরিয়া উপজেলার বাসিন্দা তিন রেমিটেন্স যোদ্ধার মৃতদেহ দুবাই থেকে তাদের বাড়িতে পৌছানো পর্যন্ত সবধরনের যাবতীয় খরচ আমাদের সংগঠনে পক্ষ থেকে বহন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের সংগঠন দেশে এবং দেশের বাইরে অর্থ্যাৎ প্রবাসে রেমিট্যান্স যোদ্ধা সবার জন্য কাজ করে আসছে। আমরা সবার জন্য পাশে আছি।